কৃচ্ছ্রকালে কার স্বার্থে এলজিইডির প্রকল্প


কৃচ্ছ্রকালে কার স্বার্থে এলজিইডির প্রকল্প
জলবায়ু ও দুর্যোগের অভিঘাত মোকাবিলা করে ফসলের আবাদ ও মাছের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সম্প্রতি একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পেশ করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। নাম \'ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্ট স্মল-স্কেল ওয়াটার রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট (সিডিআরএসএসডব্লিউআরএমপি)। কাজটি কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হলেও অতি উৎসাহী হয়ে ডিপিপি বানিয়ে সেই দায়িত্ব পালন করতে চায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তারপরও প্রস্তাবটি ত্রুটিপূর্ণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট এবং কৃচ্ছ্রকালে বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। যেখানে বিভিন্ন খাতে অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।সংকটের কারণে ডলার খরচের প্রয়োজন রয়েছে- এ রকম প্রকল্প আপাতত না করার নির্দেশ রয়েছে সরকারের। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কৃচ্ছ্রনীতি নেওয়া হয়েছে। এতে ৮৫টি প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ। ৬৩৬ প্রকল্পের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত। অর্থ সাশ্রয়ের এ রকম নীতির মধ্যেই বিদেশি ঋণের অর্থে এ রকম একটি প্রকল্প নেওয়ায় প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।এসব বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ফোনে জানতে চাইলে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। শুধু এতটুকু বলেন, তিনি অফিসের বাইরে আছেন। আপাতত এ বিষয়ে তাঁর পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়। সূত্রমতে, কৃচ্ছ্রের অংশ হিসেবে গত বছর থেকে প্রকল্পে গাড়ি কেনা বন্ধ। অথচ প্রায় কোটি টাকা দরে তিনটি গাড়ি কিনতে চায় এলজিইডি। বড় ব্যয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরও নতুন করে জরিপ বাবদ ৩০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। পরামর্শক ফি ধরা হয়েছে ১২৬ কোটি টাকা। বিদেশ সফর এবং প্রকল্পের অধীনে নতুন আবিস্কার বা উদ্ভাবনের জন্যও বড় অঙ্কের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয়, অতিরিক্ত ব্যয়ের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় খাতও সংযোজন করা হয়েছে ডিপিপিতে। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি ফেরত দিয়ে ডিপিপি পুনর্গঠনের পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) বলেছে, প্রকল্পে প্রস্তাবিত এসব ব্যয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া উদ্দেশ্যের সঙ্গে প্রকল্পের নামকরণের কোনো সামঞ্জস্য নেই। ডিপিপিতে উল্লেখ করা কাজের উদ্দেশ্য অনুযায়ী প্রকল্পটি এলজিইডির কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং কাজটি কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। এলজিইডি কেন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়, সেই ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ধানের উৎপাদন বাড়ানো-সংক্রান্ত এলজিইডির এ প্রকল্প সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। এক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কাজ অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগ করার চেষ্টা করা উচিত নয়। কারণ এক মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে অন্য মন্ত্রণালয়ের ধারণা কম। অতীতে এ ধরনের অনেক প্রকল্পের কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্পের গুণগত মানও ঠিক থাকে না।ডিপিপি ঘেঁটে দেখা যায়, প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা অনুযাযী ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কৃষি সম্পর্কিত ব্যবসার সুযোগ বৃদ্ধি ও অকৃষি কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি। এ জন্য কৃষি ও মৎস্য চাষের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ। এর মাধ্যমে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৮২৫ টনের মতো ফসল উৎপাদন। ৪২ জেলার ৩২৬টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।কমিশনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় ৩৮০টি উপপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে মাত্র ৫০টি উপপ্রকল্পের তালিকা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। কোথায় এসব উপপ্রকল্প করা হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এলজিইডির এর আগে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পের সঙ্গে এসব উপপ্রকল্পের দ্বৈততা রয়েছে। অর্থাৎ আগে বাস্তবায়ন করা উপপ্রকল্প নতুন করে করতে চায় এলজিইডি। গোটা প্রকল্প প্রস্তাবের আগাগোড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এ রকম বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক খাত সংযোজন এবং অযৌক্তিক ব্যয় প্রস্তাব রয়েছে।পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করছে। জানতে চাইলে এ বিভাগের সদস্য সরকারের সচিব এ কে এম ফজলুল হক বলেন, এলজিইডির ডিপিপির ওপর পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তাঁরা। কোথায় আপত্তি, কেন আপত্তি- সেগুলো জানানো হয়েছে এলজিইডিকে। আপত্তির জবাবও চাওয়া হয়েছে। জবাব পেলে যাচাই করা হবে। তবে এখনও এলজিইডির পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশনে কোনো ব্যাখ্যা পাঠানো হয়নি। প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রায় ১০০ কোটি টাকা এবং ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) ৩৭০ টাকা ঋণ এবং নেদারল্যান্ডস সরকার ১৫৩ কোটি টাকা অনুদান দেবে। বাকি ৩৬০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব জোগানের কথা। তবে বিদেশি ঋণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা-সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট নেই ডিপিপিতে। ঋণদাতা উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ঋণচুক্তি এমনকি সাধারণ আলোচনারও কোনো দলিল নেই। এ কারণে অর্থায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পে ৩৭৭ জন জনবল নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনবল-সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশ নেই। এসব আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। তবে বিদেশি ঋণ পাওয়ার সুবিধার্থে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অননুমোদিত নতুন প্রকল্প হিসেবে এটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।প্রকল্পের প্রতিটি খাতে আলাদা ব্যয় দেখানোর নিয়ম রয়েছে। তবে এই প্রকল্পটির ৮৪টি আইটেমের ২৮টিতে আলাদা ব্যয় না দেখিয়ে মোট ব্যয় থেকে থোক হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন- প্রকল্পের ৩৮০ উপপ্রকল্পের মধ্যে ১৫০টি নতুন করে এবং ২৩০টি উপপ্রকল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি বাবদ থোক হিসেবে ৮৩৫ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। আলাদা করে ব্যয় দেখানো হয়নি। কমিশন বলেছে, প্রতিটি আইটেমের আলাদা বিস্তারিত ব্যয় দেখাতে হবে। আলাদা ব্যয় না দেখালে কী ক্ষতি- জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যয়ের খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট বিভাজন না থাকলে আর্থিক অনিয়ম করার দুরভিসন্ধি সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়। এতে প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের সঙ্গে সময়ও বাড়ে। এ ধরনের কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন করা উচিত নয়।কৃচ্ছ্র সাধনের অংশ হিসেবে গত ৪ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সব ধরনের নতুন সরকারি গাড়ি কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারের উল্লেখ করে বলেছে, গাড়ি কেনার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া প্রকল্পের অনেক খাতে অযাচিত ব্যয় দেখানো হয়েছে।অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্য ব্যয় ছাড়াও প্রকল্পটিতে উদ্ভট অনুষঙ্গ যুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবন বাবদ প্রায় ১২ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। একটা প্রকল্পের আওতায় কি উদ্ভাবনীর সুযোগ রয়েছে- তা জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ ছাড়া সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর স্থগিত করেছে সরকার। এরই মধ্যে বিদেশে এবং দেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ২৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে ডিপিপিতে। এগুলো বাদ দিতে বলেছে কমিশন।