তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প পাঁচ দিন পরও প্রাণের সন্ধান লাশের সারিও দীর্ঘ হচ্ছে


তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প পাঁচ দিন পরও প্রাণের সন্ধান লাশের সারিও দীর্ঘ হচ্ছে
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জীবিত উদ্ধারের আশা একেবারেই কমে এসেছে। এরই মধ্যে পাঁচ দিন পার হয়ে গেছে। তবু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় তাঁবু গেড়ে তীব্র শীতের মধ্যে রাত পার করছেন স্বজনরা। তাঁরা প্রার্থনায় হাত তুলছেন, প্রত্যাশা করছেন যদি কোনো স্বজন ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত ফিরে আসেন। উদ্ধারের চেষ্টাও চলছে অব্যাহত ও অক্লান্তভাবে। মৃত্যুর মিছিলে অলৌকিকভাবে জীবিতের সন্ধান হাসি ফোটাচ্ছে উদ্ধারকর্মীদের মুখেও। তাই স্বজনের মতো তাঁরাও আশা ছাড়ছেন না। গতকাল ভূমিকম্পের ১০১ ঘণ্টা পর অন্তত ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।এরই মধ্যে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ২২ হাজার ছাড়িয়েছে। তুরস্কে প্রাণ গেছে ১৯ হাজার ৩৮৮ জনের। সিরিয়ায় মারা গেছেন ৩ হাজার ৩৭৭ জন। মৃত্যুর হিসাবে ও ভয়াবহতায় এরই মধ্যে ১৯৯৯ সালের ইস্তাম্বুল ভূমিকম্পকে ছাড়িয়ে গেছে এবারের ভূমিকম্প। ইস্তাম্বুলে ওই বছর ভূমিকম্পে প্রাণ হারান ১৭ হাজার ১২৭ জন। গত সোমবারের ভূমিকম্পে তুরস্কের কয়েকটি শহর একেবারে ধুলায় মিশে গেছে। এর মধ্যে হাতায় প্রদেশের আন্তাকিয়া অন্যতম।তুরস্কে ব্যাপক উদ্ধার তৎপরতা চললেও তা প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুততর সময়ে করা যায়নি বলে স্বীকার করেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান। দুর্গত আদিয়ামান শহর পরিদর্শনকালে শুক্রবার তিনি বলেন, এত বেশি ভবন ধসে পড়েছে, দুর্ভাগ্যবশত তাঁরা প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুততর সময়ের মধ্যে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারেননি।সোমবারের ওই ভূমিকম্পে প্রতিবেশী সিরিয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও এর প্রকৃত চিত্র গণমাধ্যমে উঠে আসছে না। সিরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিদ্রোহীরা। এসব এলাকায় উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে হোয়াইট হেলমেট গ্রুপ। তারা বলছে, সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থা \'অত্যন্ত বিপর্যয়কর\'। বিবিসি রেডিও ফোরের সঙ্গে আলাপকালে সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবী আউবাদাহ আলওয়ান বলেন, উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য তাঁদের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। এ ছাড়া জ্বালানি ও অ্যাম্বুলেন্সও নেই। তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে আসা মানুষের উদ্ধারের আকুতি অনেকটাই কমে এসেছে। সিরিয়ায় আরও বেশি স্বেচ্ছাসেবী ও সংস্থার অংশগ্রহণ দাবি করেন তিনি। আউবাদাহ আলওয়ান বলেন, অবস্থা খুবই কঠিন।হোয়াইট হেলমেট গ্রুপের অভিযোগ, ভূমিকম্পে জাতিসংঘ যথাযথ সাড়া দিচ্ছে না। তাদের সাড়া নিরপেক্ষও নয়। ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে জেনেভায় জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে ইদলিবে স্বেচ্ছাসেবী রাইদ আল-সালেহ বলেন, ভূমিকম্পের ১০০ ঘণ্টা পার হওয়ার পর মাত্র ছয় ট্রাক ত্রাণ পাঠানো হয়েছে।গতকাল আলেপ্পোয় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। সেখানে তিনি উদ্ধারকারীদের সঙ্গে হাত মেলান ও উদ্ধারকাজের তদারকি করেন। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানায়, সিরীয় সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলেও ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।সিরিয়ার উপকূলীয় শহর জাবলেহের বাসিন্দা মোহাম্মদ দায়া। বিপুল সংখ্যক মানুষকে কবর দিতে তিনি তাঁর কৃষিজমিকে সমাধিক্ষেত্রে পরিণত করেছেন। তিনি বলেন, \'জীবিতদের আমরা কোনো সহায়তা করতে পারছি না। অন্তত মৃতদের প্রতি যেন সম্মান দেখাই।\' যেখানে তিনি টমেটো ও মরিচের চাষ করতেন, সেখানে এরই মধ্যে ১৬ জনকে কবর দেওয়া হয়েছে।স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে বসবাস করেন তুরস্কের ব্যবসায়ী সাহিন ফিরাত। তিনি জানান, ভূমিকম্পে তিনি পরিবারের সদস্যসহ ১২০ জনের বেশি স্বজন ও প্রতিবেশী হারিয়েছেন। তাঁরা সবাই আদিয়ামান শহরের কেন্দ্রে থাকতেন। তিনি বলেন, তুরস্কের সার্বিক পরিস্থিতি আরও খারাপ। লোকজন গাড়ি অথবা রাস্তায় বাস করছেন। বৃষ্টি না থাকলে তাঁরা রাস্তায় কাঠ অথবা কাগজ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে অবস্থান করছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো বলছে, তারা তুরস্কে দুর্গতদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করবে।তুরস্কে উদ্ধারকাজে সবচেয়ে বড় বাধা তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়া। সেখানে রাতের তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে। তবে জীবিত পাওয়ার আশা ছাড়ছেন না উদ্ধারকর্মীরা। গতকাল আদিয়ামান থেকে ৬০ বছরের আইয়ুপ আককে ১০৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা তখনও ধ্বংসস্তূপের ভেতরেই ছিলেন। এ ছাড়া হাতায় একটি পাঁচতলা ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ছয়জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। আলজাজিরা জানায়, ভূমিকম্পের পঞ্চম দিনে দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে কমপক্ষে ৯ শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এরদোয়ান জানান, উদ্ধারকাজে সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য অংশ নেন।তুরস্ক ও সিরিয়ায় জরুরি ত্রাণের জন্য প্রাথমিকভাবে সাড়ে ৮ কোটি ডলার প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে তুরস্কে উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাংলাদেশসহ বহু দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে।