তৃতীয় দেশের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ চায় রাশিয়া


তৃতীয় দেশের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ চায় রাশিয়া
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বেলজিয়াম থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফটে নিষিদ্ধ রয়েছে রাশিয়ার অধিকাংশ ব্যাংক। তাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দেওয়া রাশিয়ার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। দেশটি চাইছে, তাদের মুদ্রা রুবলে পরিশোধ করা হোক। তবে বাংলাদেশ তাতে রাজি না হওয়ায় তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে আটকে থাকা ২১ কোটি ৪০ লাখ ডলার পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো। কীভাবে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পরিশোধ করা যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে ঢাকা।বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সংক্রান্ত রাশিয়া-বাংলাদেশ আন্তঃসরকার কমিশনের তিন দিনের বৈঠক ভার্চুয়াল মাধ্যমে গতকাল সোমবার শুরু হয়েছে।বৈঠকের প্রথম দিন তৃতীয় দেশের মাধ্যমে তাদের পাওনা পরিশোধের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সহজ ব্যাংকিং লেনদেন চালু করাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত ১৪টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।এদিন রাশিয়ার দিক থেকে নেতৃত্ব দেন কমিশনের চেয়ারম্যান ও রাশিয়া ফেডারেশনের ফেডারেল এজেন্সি ফর ফিশারিজের প্রধান ইলিয়া ভি শেসতাকভ। আর বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব উত্তম কুমার কর্মকার। আজ ও আগামীকালের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে ইআরডি সচিব শরিফা খানের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা রয়েছে।মস্কোর দলে দেশটির পররাষ্ট্র, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্য, কৃষি, পরিবহন, মৎস্য, বিজ্ঞান, উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১৭ জন অংশ নিচ্ছেন। ঢাকার দলে রয়েছেন ২০ জন প্রতিনিধি।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব উত্তম কুমার কর্মকার বলেন, রূপপুরের ঋণের কিস্তি প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখ ডলার পরিশোধ করা যাচ্ছে না। কীভাবে তা পরিশোধ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মঙ্গল ও বুধবারও বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হবে। এর পর সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়ার অধিকাংশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফটে নিষিদ্ধ থাকায় বাংলাদেশকে বিকল্প হিসেবে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতিতে লেনদেন নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয় দেশটি। এভাবে অর্থ পরিশোধের বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরে মস্কো। ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে (প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্র) এড়িয়ে দুই দেশ নিজ নিজ মুদ্রায় লেনদেন করার প্রক্রিয়াকে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ বলা হয়।এ পদ্ধতিতে রাশিয়াকে ঋণ পরিশোধ করলে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে ঋণের কিস্তি তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো। এ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানতে চেয়েছে ঢাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, যেসব দেশ ‘কারেন্সি সোয়াপ’ পদ্ধতিতে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন করে, সেসব দেশকে ডলার দেবে বাংলাদেশ। ওই দেশ বাংলাদেশের হয়ে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করবে।বাংলাদেশে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ৫০ কোটি ডলারের প্রথম ঋণচুক্তি হয়। ওই অর্থ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিস্তারিত সমীক্ষাসহ প্রাথমিক কাজ করে সরকার। ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় ঋণ পরিশোধ। এখন পর্যন্ত আট কিস্তিতে ৪০ কোটি ডলার শোধ হয়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। এতে সুদ-আসলে ওই ঋণের ২১ কোটি ৪০ লাখ ডলার আটকে গেছে। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের রূপপুর প্রকল্পটি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে রাশিয়ার কাছ থেকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৭ সাল থেকে। তবে ওই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি থেকে যেসব ভারী যন্ত্রপাতি আসার কথা, সেগুলো আসছে না। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিকল্প উৎস খুঁজতে হচ্ছে।সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যখন বাণিজ্য সচিব ছিলেন, তখন তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি দল ২০১৩ সালের অক্টোবরে রাশিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও ইউক্রেন সফর করে। এরই ধারাবাহিকতায় অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি সহায়তা বিষয়ে ২০১৭ সালের ১ মার্চ গঠন করা হয় বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তঃসরকার কমিশন। আন্তঃসরকার কমিশনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। প্রথমটিসহ ঢাকা-মস্কো মিলিয়ে তিনটি আলাদা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এবারের অধিবেশন মস্কোতে হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ডলার সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে তা ভার্চুয়ালি হচ্ছে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।সূত্র জানায়, গতকাল অনুষ্ঠিত প্রথম দিনের আলোচনায় মূল বিষয়বস্তু ছিল রূপপুরের কিস্তি পরিশোধের পদ্ধতি নির্ধারণ। এ ছাড়া সরাসরি ব্যাংকিং কার্যক্রমসহ জ্বালানি ও ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়গুলোও আলোচিত হয়। পাশাপাশি ছিল পারমাণবিক শক্তি খাতের সহযোগিতা এবং বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক খাতের সহযোগিতা। রাশিয়া-বাংলাদেশ আন্তঃসরকার কমিশনের পঞ্চম অধিবেশন কবে, কোথায় হবে, সে আলোচনাও হয়।অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন আজ রেল ও কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড), বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে রাশিয়ার বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হবে। শেষ দিন বুধবার প্রটোকল সই হওয়ার কথা রয়েছে।