নবদিগন্ত উন্মোচন ॥ বাংলাদেশ ও জাপান সম্পর্কের
অনলাইন নিউজ ডেক্স

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত হওয়ার কথা জানিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ও সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয়েই দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, আগামীতে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে।
বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় টোকিওতে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের শীর্ষ প্রতিনিধিদের নিয়ে এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান জাপানের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে যৌথ বিবৃতিতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেন, আমরা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছি। আগামীতে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে।
যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রধানমন্ত্রী কিশিদা এবং আমি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব কিছু নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা আনন্দিত যে বাংলাদেশ ও জাপান সফলভাবে বিদ্যমান সম্পর্ক ‘ব্যাপক অংশীদারিত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর একই স্থানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বিবৃতি দেন। যৌথ বিবৃতির আগে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বৈঠকে তারা (ফুমিও কিশিদা-শেখ হাসিনা) ‘কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে আইনের শাসনের ভিত্তিতে অবাধ ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সমুন্নত দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। এখন বিশ্ব ব্যবস্থার ঐতিহাসিক ‘টার্নিং পয়েন্ট’। তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর করতে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে।
গত মাসে ঘোষিত অবাধ এবং উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক পয়েন্টের জন্য নতুন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের বৈঠকে জাপান ও বাংলাদেশ বিস্তৃত ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। কিশিদা বলেন, আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাপানের সম্ভাবনা-বাংলাদেশ ইকোনমিক অংশীদারিত্ব চুক্তির বিষয়ে যৌথ সমীক্ষায় ব্যাপকভাবে এগিয়ে যেতে সম্মত হয়েছি।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা বাংলাদেশ একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য। আমাদের প্রত্যাশা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ফুমিও কিশিদা বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা এই ইস্যুতে সহায়তা অব্যাহত রাখব।
এদিকে, যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন বলেন, আমি নিশ্চিত আমাদের দুই দেশের জনগণ এবং আমাদের সরকারের মধ্যেকার বিদ্যমান চমৎকার বোঝাপড়া, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা আগামী বছরগুলোতে আরও শক্তিশালী হবে। আমাদের দুই পক্ষ কৃষি, শুল্ক সংক্রান্ত, প্রতিরক্ষা, তথ্য-প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, শিল্পোন্নয়ন, মেধা সম্পদ, জাহাজ রিসাইক্লিং এবং মেট্রোরেল বিষয়ে আমরা দুই দেশ আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছি। এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক আমাদের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ক্ষেত্রে তা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে।
ঢাকা-নারিতা সরাসরি ফ্লাইট চালু প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি এই বছরের মধ্যে ঢাকা-নারিতা সরাসরি ফ্লাইট চালু হতে যাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বঙ্গোপসাগর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের জন্য মহেশখালী-মাতারবাড়ি ইন্টিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট উদ্যোগ এবং বিগ-বি উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা করার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।
জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার হওয়ায় আমরা জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। সামনের দিনগুলোতে আমরা একটি অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (ইপিএ) সম্পাদন করার অপেক্ষায় আছি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের সহযোগিতা চাওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আলোচনা করেছি। রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। আমরা জাপানকে অনুরোধ করেছি মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে এ সংকটের একটি টেকসই সমাধান খুঁজতে।
জাপানের আতিথেয়তার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী কিশিদা এবং জাপান সরকার আমাকে এবং আমার প্রতিনিধিদলকে যে আতিথেয়তা দেখিয়েছে তাতে আমরা গভীরভাবে মুগ্ধ। তিনি বলেন, সুন্দর দেশ জাপানে আসাটা আনন্দের। জাপান সব সময় আমাদের হৃদয়ে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তির পর সরকারি সফরে টোকিওতে আসতে পেরে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাপান বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি যে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাপান তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বৃহত্তম অংশীদার হওয়ায় আমরা জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা জাপানের সঙ্গে আগামী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পন্ন করার অপেক্ষায় আছি। আমার হৃদয়ঘনিষ্ঠ জাপানোর মতো একটি সুন্দর দেশে অবস্থান আমার জন্য সব সময় আনন্দের বিষয়।
এর আগে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশাদার সঙ্গে বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজপ্রাসাদে (ইমপেরিয়াল প্যালেস) জাপানের স¤্রাট নারুহিতোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সময় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী অবদুল মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক উপস্থিত ছিলেন।
মহামারি কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার আগে ২০১৯ সালে সর্বশেষ সফরের পরে তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর করছেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার আমন্ত্রণে মঙ্গলবার দ্বিপক্ষীয় সফরে টোকিও আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ যাত্রায় তিন দেশ সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপান সফর শেষে শুক্রবার তিনি টোকিও থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন যাবেন। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের লন্ডন যাবেন প্রধানমন্ত্রী। তিন দেশ সফর শেষে মঙ্গলবার সকালে দেশে ফিরবেন।
