মানসম্মত গবেষণা বাড়লেও অর্থায়নে দৈন্য প্রকট
অনলাইন নিউজ ডেক্স

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য সর্বাধিক পরিচিত দেশের একমাত্র উচ্চতর গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠানকে দেশের সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠার ৫২ বছরে উচ্চতর গবেষণায় খুব বেশি না এগোলেও গত কয়েক বছরে মানসম্মত গবেষণা বেড়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিষয়ক গবেষণা উল্লেখ করার মতো। কিন্তু এ কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বাড়েনি অর্থায়ন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে চোখে পড়ার মতো। ফলে অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব খরচেই গবেষণা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অধিকার আদায়, ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের কারণেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা আইনে পরিণত হয়েছে।এ ছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কৃতী শিক্ষক-শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজ কর্মের মাধ্যমে অবদান রাখছেন। যেমন অর্থনীতিতে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং নাটকে সেলিম আল দীনের মতো ব্যক্তিত্ব অসামান্য অবদান রেখেছেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আবিস্কার করেছিলেন উয়ারী-বটেশ্বর। এ ছাড়া এই বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শাহনাজ বিশ্ব সভ্যতা নিয়ে অনেক গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন। প্রত্নতত্ত্ব ও উপমহাদেশের ইতিহাসচর্চায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ নাম স্বাধীন সেন। তাঁর লেখা আর্টিকেল নিয়মিত বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়। রায়হান রাইন বাংলার দর্শন ও কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলা দর্শন নিয়ে তাঁর কাজ বুনিয়াদি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী সর্বপ্রথম বাংলায় নৃবিজ্ঞানের বই লেখেন। নৃবিজ্ঞানকে বঙ্গদেশীয় করতে তাঁদের ভূমিকা রয়েছে।আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনডেক্স স্কোপাসের তথ্যমতে, ১৯৭৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সাড়ে চার হাজারের বেশি গবেষণা নিবন্ধ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি, গবেষণায় তাঁদের আগ্রহ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত অর্থায়ন নেই। সম্প্রতি নিজেদের অর্থায়নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণা শুরু করেছেন। এ জন্য ২০২২ সালে গত ৫২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৭৯টি গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।এ ছাড়া ১৯৭৫ থেকে \'৭৯ সালে আন্তর্জাতিক জার্নালে বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো গবেষণা নিবন্ধই প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭৪ এবং ১৯৮০ থেকে \'৯১ সাল পর্যন্ত নিবন্ধের সংখ্যা ছিল ১০টির নিচে। তবে ২০০৮ সালের পর থেকে নিবন্ধের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২০১; ২০১৮ সালে ২৩০; ২০১৯ সালে ৩২০; ২০২০ সালে ৪৪২ এবং ২০২১ সালে পাঁচশর বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।আন্তর্জাতিক এই গবেষণা ইনডেক্স অনুসারে, ২০২২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্নিষ্ট গবেষকরা মেডিসিনে ১৪৯টি, প্রকৌশলে ১৪৪টি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক ১২৮টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া রসায়ন, কৃষি, প্রাণরসায়ন ও বংশগতিবিদ্যা এবং জীববিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা হয়েছে। ৭৭৯টি গবেষণার মধ্যে ৫৯৮টি প্রবন্ধ বিশ্বের বিখ্যাত বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।গত বছর আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা বিভিন্ন জার্নালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত ৭৭৯টি গবেষণার অধিকাংশই চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানবিষয়ক। চিকিৎসা কিংবা প্রকৌশল সংক্রান্ত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান না হয়েও গবেষণাক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন সংশ্নিষ্টরা। আর এ জন্যই বিশেষ এ খাতগুলোতে গবেষণায় আগ্রহ এবং গবেষণাপত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি; আণবিক, চিকিৎসা এবং প্রকৌশলকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি স্বতন্ত্র অনুষদ প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন গবেষকরা।এ বিষয়ে জীববিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক নূহ আলম বলেন, আমাদের পাঁচটি বিভাগ সরাসরি মেডিকেল স্বাস্থ্যসংক্রান্ত। স্বাভাবিকভাবেই এসব বিষয়ে গবেষণা বাড়ছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ফ্যাকাল্টির প্রয়োজন আছে। সে ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে বিভাগ না খুলে গঠনমূলক উপায়ে কাজ করতে হবে।গত এক বছরে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮০০টি গবেষণার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১৮টিতে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২৩টিতে অর্থায়ন করেছে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থায়ন করেছে এমন ৩৯টি গবেষণা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাড়ে তিনশর বেশি গবেষণা প্রকল্পে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।অন্যদিকে প্রকাশিত মোট গবেষণাপত্রের ২১ শতাংশ প্রকাশ করেছেন তিন শিক্ষক ও দুই ছাত্র। তাঁদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১৩৬টি। গবেষণাপত্র প্রকাশের সংখ্যায় তালিকার শীর্ষে রয়েছেন পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৩৯টি। ২৮টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক শামীম কায়সার। তৃতীয় অবস্থানে থাকা পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের প্রকাশিত গবেষণার সংখ্যা ২৬টি। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ ২৪টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে রয়েছেন তালিকার চতুর্থ অবস্থানে।সম্প্র্রতি জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথে এপিডেমিওলজিতে মাস্টার্স করবেন। বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় স্থ্থান পাওয়া মামুনের শতাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।গবেষক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমি নিজে থেকেই গবেষণা করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো গবেষণার জন্য অর্থায়নের আগ্রহ দেখিনি। আমার মতো আরও অনেকেই গবেষণায় আগ্রহী। কিন্তু অর্থের অভাবে করতে পারছেন না।বিশ্ববিদ্যালয় নানা ক্ষেত্রে উন্নত হলেও শিক্ষা ও গবেষণায় পিছিয়ে আছে জানিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, গবেষণার জন্য আগ্রহ, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা এবং সেটার কার্যকারিতা থাকতে হবে। প্রথমত, রাষ্ট্র বা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে দেখতে চায়, তার ওপর গবেষণা অনেকটা নির্ভর করে। আমাদের দেশে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখে তার সমর্থক গোষ্ঠী তৈরির কারখানা হিসেবে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে যতটুকু গবেষণার সুযোগ থাকা উচিত, সেখানেও উদ্যোগের অভাব আছে। এ ছাড়া ৫০ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কোনো নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা। তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষা ও গবেষণায় আগ্রহীদের প্রাধান্য নিশ্চিত করা। কিন্তু এখানে শিক্ষা ও গবেষণায় যাঁদের আগ্রহ নেই, তাঁদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের লোক যদি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে এখানে শিক্ষা ও গবেষণার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।কথাসাহিত্যিক রায়হান রাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক দিকটায় গুরুত্ব আরোপ করা কমে গেছে। এটা বাড়াতে হবে। গবেষণার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়কে জোর দিতে হবে।জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফরিদ আহমদ বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার জায়গাটিতে অনেক এগিয়েছেন। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠবে।
