
অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গন। গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে এই খাতে মন্দাভাব কাটেনি। নানাভাবে বর্তমান সরকার সংস্কৃতি বা বিনোদন মাধ্যম স্বাভাবিক করার চেষ্টার কথা বললেও সেটাও গতি পায়নি। ঈদ-কেন্দ্রিক সিনেমা মুক্তি, টেলিভিশন নাটকের বাজেট কমে যাওয়া থেকে শুরু করে মঞ্চ নাটকের ওপরেও প্রভাব পড়েছে।সবশেষ জুলাই আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলায় বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে। যদিও ব্যাপক সমালোচনার মুখে একদিন পরে তাকে জামিন দেয়া হয়।ওই মামলায় ২৮৩ জন আসামির মধ্যে আরও অনেক শিল্পীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে অনেক শিল্পীও হয়রানি বা হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।তবে নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতারের ঘটনার পর থেকেই ভয়ে বা অস্বস্তিতে পড়েছেন দেশের বিনোদন মাধ্যমের অনেক শিল্পী।কাদের বিরুদ্ধে মামলা?পাঁচই অগাস্টের পর ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি প্রকাশ্যে শিল্পীকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।তবে সবশেষ বেশি আলোচনা বা সমালোচনা তৈরি হয়েছে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার আটকের ঘটনায়।হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে যে মামলা করা হয়েছে, ওই মামলায় বর্ণিত ঘটনার সময় বিদেশে অবস্থানরত নুসরাত ফারিয়া ছাড়াও আরও অনেকের নাম রয়েছে।এ রকম বেশ কয়েকটি মামলায় আসামি হিসেবে প্রায় ২৭ জন শিল্পীর নাম এসেছে।তারা হলেন- নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, নিপুন আক্তার, কামরুন নাহার শাহনূর, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সোহানা সাবা, তানভীন সুইটি, মেহের আফরোজ শাওন, জাকিয়া মুন, জ্যোতিকা জ্যোতি, সুবর্ণা মুস্তফা, আশনা হাবিব ভাবনা, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহান, অরুণা বিশ্বাস, শামীমা তুষ্টি, শমী কায়সার, সাজু খাদেম, সোহানা সাবা, জায়েদ খান, সাবেক সংসদ সদস্য ফেরদৌস, রিয়াজ, চঞ্চল চৌধুরী, আজিজুল হাকিম, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান, ইরেশ জাকের।এছাড়া বিএনপির কাউন্সিলর পদপ্রার্থী সৈয়দ হাসান মাহমুদকে ২০২২ সালের ২৫ জুন হত্যাচেষ্টা ও গুমের অভিযোগে গত বছরের নয়ই অক্টোবর দায়ের করা মামলায় অভিনেত্রী তারানা হালিম, মমতাজ ও শমী কায়সারকে আসামি করা হয়। তবে সেটি জুলাই আন্দোলন কেন্দ্রিক মামলা ছিল না।এসব মামলা প্রসঙ্গে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, মানুষের পক্ষে কথা বলেছে, শিল্পীরা তো স্বাভাবিকভাবে মানুষের পক্ষে কাজ করা মানুষ। শিল্পীদের এভাবে ঢালাওভাবে মামলায় ফেলে, একের পর এক মামলা দিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করা এবং তাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার চাদরে মুড়ে দেওয়া, এটা অদ্ভুত রকমের সংস্কৃতি।’বিষয়টি নিয়ে কানাডা থেকে কথা বলেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী মোশাররফ করিম।বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘ব্যাপারটা শুধু শিল্পীর ক্ষেত্রে না, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অপরাধী হলে মামলা হতে পারে। আটকও হতে পারেন। তবে সেটা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হলে ভালো। তাতে সমাজের সামগ্রিক ডিসিপ্লিন রক্ষা হয়।’তিনি আরও বলেন, ‘তবে কেউ যদি ইনটেনশনালি কারো ওপর ক্রোধ আছে সেটা জাহির করতে যায় সেটা খারাপ। এটা ঠিক না। কারণ এমন ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে যায়। আর দৃষ্টান্ত স্থাপন হলে সেই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে চলতে থাকে। অন্য যারা যখন ক্ষমতায় আসে তারাও একই কাজ করবে। এটা কোনো কালের জন্য সুখকর না। তবে ব্যক্তি অপরাধী হলে সেটার জন্য মামলা হতে পারে।’শিল্পীদের মামলা প্রসঙ্গে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, পুরো বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি।জুলাই আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের পক্ষে বেশ সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন বাঁধন।আজমেরী হক বাঁধন। ছবি: সংগৃহীত
বাঁধনের মতে, ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা স্বৈরাচার বিদায় করেছি সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। উপদেষ্টারা সবাই প্রচণ্ড ভালো মানুষ। বেশি ভালো মানুষ হওয়ার কারণে কোনো কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। যেখানে যারা ছিল সেখানেই আছেন। বিশেষ করে আমাদের কাজের যে জায়গা সেখানে আগে একরকম সিন্ডিকেট ছিল। এবার নতুন সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তারাই এখন কাজ করছে।’শিল্পীদের রাজনীতি করা প্রসঙ্গে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘শিল্পীরা যে কোনো রাজনৈতিক দলকে সাপোর্ট করতে পারেন বা নাও করতে পারেন। কে কার সঙ্গে ছবি তুলবেন বা বাহবা দেবেন সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। তিনি তো কোনো ক্রাইম করেননি। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ক্রাইম করবেন না ততক্ষণ আইন তাকে আটকাতে পারবে না।’গত বছরের পাঁচই অগাস্টে সরকার পতনের পর বিনোদন জগত অনেকটাই স্থবির হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর নাগাদ ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করে। কিন্তু আগের মতো এই শিল্প পুরোপুরি সচল হয়নি। বিশেষ করে চলচ্চিত্র, নাটকের কাজ অনেক কমে গেছে।চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এক ধরনের স্থবিরতা এসেছে। তার বড় কারণ বিনিয়োগকারী না থাকা। হঠাৎ করেইে এই মাধ্যমে বিনিয়োগকারী কমে গেছে। এ কারণেই কাজ কমে যায়। আমার ধারণা বিনোদন মাধ্যমের সকল সেক্টরে বিশেষ করে গান, নাটক, সিনেমা সব খানে ৮০ ভাগ কাজ কমে গেছে।’তবে কাজ কমে যাওয়া নিয়ে খানিকটা ভিন্ন মত দেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আখন্দ।তিনি বলেন, ‘নভেম্বর-অক্টোবর অব্দি কাজ কমে গিয়েছিল। এখন কিছুটা বেড়েছে। কাজ তো আসলে নাটক, সিনেমা বা ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য হয়। তাই কাজের গতি ওই সময়টা কমে গিয়েছিল।’কিন্তু যেসব ইউটিউব চ্যানেল-ভিত্তিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি বাজেটে কাজ করতো তারা কাজ কমিয়ে দিয়েছে বলে বলছেন মি. তারেক।বিষয়টি নিয়ে একমত পোষণ করেন দেশের ইউটিউব-ভিত্তিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিএমভির কর্ণধার এবং মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- এর সাধারণ সম্পাদক এসকে সাহেদ আলী পাপ্পু।বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আখন্দ ও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন- এর সাধারণ সম্পাদক এসকে সাহেদ আলী পাপ্পু। ছবি: সংগৃহীত
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গতবছর থেকে এ বছরের তুলনায় যাবো না, তবে গত কয়েকমাসে ১০ থেকে ২০ ভাগ কাজ কমে গেছে। এটার বড় কারণ বাণিজ্যিক অবস্থার ওপর নির্ভর করছে। মোট কথা আমাদের ইউটিউব কনটেন্টে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমে গেছে।’এছাড়া ঈদ ছাড়া কোনো সিনেমায় গত কয়েকমাসে ব্যবসা সফল হয়নি। যদিও পাঁচ আগস্টের আগে সিনেমার বাজার ওইরকম ছিল। চলচ্চিত্র শাকিব খানের সিনেমাও ঈদ ছাড়া ব্যবসা সফল হয়নি বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।শিল্পীদের অনেকে বলেছেন, বিশেষ করে যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্রসহ যেসব নাটকের কাজ চলছিল, সেগুলো এখন বন্ধ হয়ে গেছে।অভিনয় শিল্পী আজমেরী হক বলেন, ‘আমার ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় দুটি সিনেমায় অভিনয় করার কথা ছিল। সেই প্রজেক্ট বাতিল হয়ে গেছে। তবে বাকি কাজগুলো হচ্ছে। তবে এখন কাজের সুযোগ অনেক খানিকই কমে গেছে। আশা করছি সেটা দ্রুত পরিবর্তন হবে।’
