আটকে গেছে ড্যাপ বাস্তবায়ন


আটকে গেছে ড্যাপ বাস্তবায়ন
ঢাকার মহাপরিকল্পনা ড্যাপ সংশোধন কেন্দ্র করে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। এতে ড্যাপ অনুযায়ী বাসযোগ্য শহর গড়ার নানা আয়োজনের বাস্তবায়ন কার্যত আটকে গেছে। এই মহাপরিকল্পনা গেজেটভুক্ত হওয়ার আড়াই বছর পার হলেও বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।তাদের মতে, ড্যাপ সংশোধন ইস্যুতে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের অবস্থান মুখোমুখি। দুপক্ষই নানা যুক্তি দিচ্ছেন। এখানে একটি পেশাজীবী গোষ্ঠী এবং অপরটি শহরের উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সরকার কাউকে বাদ দিয়ে কাজ করতে পারে না। এজন্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা সবার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির যৌক্তিক সমাধানের চেষ্টা করছে।তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা শহরকে পরিকল্পিত, বাসযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এই মহাপরিকল্পনার নাম বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ। এটি ২০২২ সালে গেজেটভুক্ত হওয়ার ১ বছরের মাথায় কারিগরি মতামত উপেক্ষা করে আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ২০২৩ সালে একদফা সংশোধন করা হয়।এরপর রাজউক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে থাকলেও গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিদ্যমান ড্যাপকে বৈষম্যবিরোধী আখ্যা দিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীরা আবারও সংশোধনের দাবি তোলে। নানামুখী চাপে রাজউক আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়ে ড্যাপ সংশোধন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার প্রথম পর্বে নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে রাখলেও মাঝপথে তাদের বাদ দিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেয় রাজউক।তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, নগর পরিকল্পনাবিদদের বাদ দিয়ে ঢাকার মহাপরিকল্পনা সংশোধনের এই প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ দাবি করে দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব প্লানার্স (বিআইপি)। এর বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)।পরে আবাসন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আন্দোলন জোরদারে গঠিত হয়েছে ঢাকা সিটি ভূমি মালিক সমিতি। তারাও সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানাবিধ কর্মসূচি পালন করেছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের আদলে ড্যাপ সংশোধন চূড়ান্ত করতে সভা আহ্বান করে ড্যাপ রিভিউসংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি। এর আগের দিন জাতীয় প্রেসক্লাবে পরিকল্পনাবিদসহ বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি সংবাদ সম্মেলন করে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয় সরকারকে।ঠিক একই সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ঢাকা সিটি ভূমি মালিক সমিতির ব্যানারে ড্যাপ সংশোধনের পক্ষে মানববন্ধন করা হয়। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ ওই সভায় ড্যাপ সংশোধনের চূড়ান্ত অনুমোদন না করে পুনরায় যাচাই-বাছাই করতে বলে। সেখানে পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে রাখতে বলেন। সেই নির্দেশনার আলোকে রাজউক ঈদের আগে সব অংশীজনের সঙ্গে একটি সভা করেছে। আরও একটি সভা চলতি মাসে হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।ড্যাপে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে : ড্যাপ সংশোধনের বিদ্যমান প্রস্তাব অনুমোদন পেলে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার ভবনের উচ্চতা, আয়তন ও ইউনিট বাড়বে। এ বিষয়গুলো নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় যুক্ত হবে। পাশাপাশি ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বিশেষ প্রকল্প অনুমোদনের শর্তও শিথিল করা হবে বলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানিয়েছেন।তাদের মতে, এই পরিবর্তন ভূমি মালিক এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনলেও শহরের বাসযোগ্যতার জন্য নেতিবাচক হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজধানীতে আরও অনেক মানুষের আগমন ঘটবে। যেটা শহরের পরিবেশ ও প্রতিবেশ নষ্ট করবে।রাজউক সূত্র জানায়, বিদ্যমান ড্যাপে ডেনসিটি জোন ছিল ৩৫০টির বেশি। এর মাধ্যমে পুরো রাজউক এলাকার বিদ্যমান সড়ক, উন্মুক্ত স্থান ও নাগরিক সেবার আলোকে ভবনের উচ্চতা, আয়তন ও ইউনিট নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ভূমি মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ডেনসিটি জোন কমিয়ে ৬৫-তে নামিয়ে এনেছে। ফলে ভবনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআরের মান অধিকাংশ এলাকার ২ থেকে ৩ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। একই হারে-ভবনের আয়তন ও ইউনিটও বাড়বে। ফলে এলাকাভেদে ৩ থেকে ৪ তলা পর্যন্ত ভবনের উচ্চতা বাড়বে।তারা জানায়, নগর পরিকল্পনার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একরপ্রতি জনসংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০ জন থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় ৪০০ থেকে ৫০০ জন রয়েছে; ড্যাপ সংশোধোনের মাধ্যমে এই জনঘনত্ব আরও কয়েকগুণ বাড়বে। এছাড়া প্রতি বর্গকিলোমিটার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষের বসবাস করার কথা। তবে ঢাকার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। তবুও জনঘনত্ব বাড়াতে মরিয়া রাজউক। এক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।অংশীজনদের অভিমত : নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শহরের বাসযোগ্যতা বিষয়টি বিবেচনা না করে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আবাসন ব্যবসায়ীদের মতো করে ড্যাপ সংশোধন করছেন; যা শহরকে আরও ধ্বংস করবে। ড্যাপ সংশোধনসংক্রান্ত সভায় বিআইপি যেসব সুপারিশ করেছিল, তার কোনোটিই সংশোধিত প্রস্তাবে রাখা হয়নি।রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূঞা বলেন, পাশাপাশি জমি; কেউ ৯ তলা ভবনের অনুমোদন পেয়েছেন। আবার কেউ ৫ তলাও করতে পারবেন না, এটা তো হতে পারে না; এটা বৈষম্য। এটা নিরসন করতে হবে।ঢাকা সিটি ভূমি মালিক সমিতির প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাত বলেন, পৃথিবীজুড়ে বহুতলা ভবন নির্মাণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর ঢাকায় নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটার সংশোধন না হলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবাসনের সংস্থানও কঠিন হয়ে পড়বে। রাজউকের ড্যাপে ২০ ভাগ এলাকায় অনেক উচ্চতা দেওয়া হয়েছে। আর ৮০ ভাগ এলাকায় খুবই কম উচ্চতা দেওয়া হয়েছে। এই বৈষম্য এই শহরের মানুষ মেনে নেবে না।কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম জানান, ড্যাপের কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। আগে যিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন; তিনি সবার সঙ্গে কথা বলে অনেকটা কাজ এগিয়ে রেখেছেন। সেটা নিয়েও অনেক কথা উঠেছে; সেসব নিয়ে আলোচনা চলছে। সবার মতামত এবং পরামর্শের ভিত্তিতে ড্যাপ সংশোধন করা হবে।তিনি জানান, ফ্লাডফ্লো জোন, ফ্লোর এরিয়া রেশিওসহ কয়েকটি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রয়েছে। এ বিষয়গুলো যৌক্তিক পর্যায়ে রেখে ড্যাপ সংশোধন করে বাস্তবায়ন কাজ ত্বরান্বিত করা হবে।