‘আমার গল্পটা মনে রেখো, আমি কেবল একটা সংখ্যা নই’


‘আমার গল্পটা মনে রেখো, আমি কেবল একটা সংখ্যা নই’
দখলদার ইসরাইলের বাহিনীর বর্বর হামলায় রীতিমত ধংসস্তূপে পরিণত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। প্রতি মুহূর্তে ঝরছে নারী ও শিশুসহ অজস্র তাজা প্রাণ। বীভৎসতায় কাঁদছে মানবতা।সেই ভয়াবহ ও বীভৎস পরিস্থিতিতে জীবনের গল্প লিখেছেন রুয়াইদা আমির নামে গাজার এক বাসিন্দা। আল-জাজিরায় প্রকাশিত রুয়াইদার সেই লেখাটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো–‘আমি একটা উইল লেখার কথা ভাবছিলাম। তবে কখনো ভাবিনি যে, মৃত্যু এতটা কাছ থেকে অনুভব করব। আমি আগে বলতাম, মৃত্যু হঠাৎই আসে, আমরা টেরই পাই না। কিন্তু চলমান যুদ্ধে তারা আমাদের সবকিছু অনুভব করিয়েছে... ধীরে ধীরে।আমরা মৃত্যুর মতো এমন সব ঘটনা ঘটার আগে কষ্ট পাই। আর এমনটা হয়– যখন তুমি জানতে পারো যে, এরপর হয়তো তোমার বাড়িটাই বোমা হামলার শিকার হবে।আমার বাড়িটা এখনো হয়তো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই ভয়টা থেকেই গেছে। আর এই ভয় আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে, যেন আর কিছু সহ্য করার শক্তি নেই।যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি ইসরাইলি বাহিনীর ভয়াবহতার এত কাছাকাছি এসে পড়েছি যে, নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এখনো মনে আছে সেই দিনের কথা, যেদিন নেটজারিম এলাকা থেকে ইসরাইলের ট্যাঙ্কগুলো প্রবেশ করছিল। আর আমি আমার সব বন্ধুর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম– ‘তারা কীভাবে গাজায় প্রবেশ করল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?’তারা গাজা থেকে চলে যাবে– আমি সেই অপেক্ষায় ছিলাম। তারা চলে গেলেই গাজা আবার আগের মতো মুক্ত-স্বাধীন থাকবে। যেমনটি আমরা সবসময় জানতাম, চাইতাম।কিন্তু তারা এখন আমার এলাকায়, আমার বাসস্থানের খুব কাছে অবস্থান করছে। খান ইউনিসের পূর্ব পাশে, আল-ফুখারিতে, রাফাহর উত্তরে। খান ইউনিস শেষ হয় আর রাফাহতে শুরু হয়।তারা আমার এতটাই কাছে যে, প্রতিটা মুহূর্তেই আমারা ভয়াবহ বিস্ফোরণ শুনতে বাধ্য হচ্ছি। এর ফলে আমরা সেই অন্তহীন শব্দ সহ্য করতে বাধ্য হই। এই যুদ্ধটা একেবারেই আলাদা, আগে যা দেখেছি তার থেকেও আলাদা।মার গল্পটা মনে রেখোআমি কেবল একটা সংখ্যা হতে চাই না। বিষয়টি এখনো আমার মনে গেঁথে আছে, যখন আমি দেখলাম ইসরাইলি হামলায় আমাদের শহিদদের ‘অজ্ঞাতনামা’ আখ্যা দিয়ে গণকবরে দাফন করা হচ্ছে। কেননা, কখনো কখনো শুধু শরীরের অংশ বিশেষ পাওয়া যায়, নামও জানা যায় না। তাদের মধ্যে কিছু শরীরের এমন অংশও আছে, যা শনাক্তও করা যায়নি।এও কী সম্ভব যে, আমার কফিনের ওপর লেখা থাকবে ‘কালো/নীল ব্লাউজ পরা এক তরুণী’? আমিও কী শেষ পর্যন্ত একজন অজ্ঞাতনামা হয়ে মারা যাবো? কেবল একটি সংখ্যা?না, আমি চাই আমার চারপাশের সবাই আমার গল্পটা মনে রাখুক। কেবল একটা সংখ্যা হিসেবে নয়।আমি সেই মেয়ে, যে কিনা কঠিন অবরোধ ও ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যেও পড়াশোনা করেছে, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে। এই অবরোধের মধ্যে আমার বাবা বেশ কয়েকবার চাকরি হারিয়েছেন। একটানা অবরোধের কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে সেই বাবাকে সাহায্য করার জন্য আমি হন্যে হয়ে সর্বত্র কাজ খুঁজছিলাম।কারণ, আমিই পরিবারের বড় মেয়ে এবং আমি আমার বাবাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম আমাদের থাকার জন্য একটি ভালো বাড়ি তৈরি করতে।কিন্তু এখন আমি একজন শরণার্থী। আমার দাদা-দাদিও ছিলেন শরণার্থী। তারা ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি দখলে নিজেদের জায়গা-জমি ঘরবাড়ি হারিয়ে গাজায় এসে আশ্রয় নেন। তারা শহরের পশ্চিমে খান ইউনিস শরণার্থী ক্যাম্পে থাকতেম।আমার জন্মও সেখানেই। কিন্তু বর্বর ইসরাইলি সেনারা আমার জীবনটা সেখানেই থামিয়ে দিল।তারা ২০০০ সালে আমাদের বাড়িটা ধ্বংস করে দেয় এবং দুই বছর ধরে আমাদের আশ্রয়হীন থাকতে হয়। আমরা একটি অনাবাসিক তাঁবু থেকে অন্য একটি বাড়িতে চলে যাই। পরে ২০০৩ সালে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা আল-ফুখারিতে আমাদের একটি বাড়ি করে দেয়।বাড়িটা ছোট ছিল, কিন্তু আমরা সেখানে ১২ বছর কাটিয়ে দিলাম।সমস্ত কৃষিজমিসহ সেই চমৎকার এলাকা, যেখানে আমরা ইউরোপীয় হাউজিং নামক পাড়ায় একটি জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করি। বাড়িটি ছোট ছিল, বাবা-মাসহ আমাদের পাঁচজনের পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এর জন্য একটি অতিরিক্ত ঘর, একটি বসার ঘর এবং রান্নাঘরের প্রয়োজন ছিল।যাইহোক আমরা সেখানে প্রায় ১২ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আমার বাবাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। এর জন্য ২০১৫ সালের দিকে আমি চাকরি শুরু করি। আমি তাকে বাড়িটি বসবাসের জন্য আরামদায়ক করতে সাহায্য করেছি।হ্যাঁ, আমরা তা করতে পেরেছি। কিন্তু এটি খুবই কঠিন ছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের মাত্র তিন মাস আগে আমরা আমাদের বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ করেছিলাম। প্রায় ১০ বছর লেগে গেছে আমাদের বাড়িটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে। আর তারপরই যুদ্ধ।হ্যাঁ, আমাদের আর্থিক সামর্থ্য কম থাকায় অল্প অল্প করে এটি পুনর্নির্মাণে আমি প্রায় ১০ বছর ব্যয় করেছি এবং যুদ্ধের ঠিক আগে আমরা এটি সম্পন্ন করতে পেরেছি।এতে আমি ইতোমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, গাজার অবরোধ ও জীবনযাপনের কঠিন পরিস্থিতির কারণে। এরপর যুদ্ধ শুরু হয় এবং আমাকে সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ করে দেয়। আমার হৃদয়কে ক্লান্ত করে দেয়।সেদিন আমি ঘুম থেকে পড়িমরি করে উঠে যাই। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা কিছু একটার জন্য লড়াই করে আসছি। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি, ক্ষুধা বা তৃষ্ণায় যেন না মারা যাই, সেজন্য লড়াই করছি। আমরা যে ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছি, যে অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছি- বেঁচে থাকার জন্য, ক্ষুধা-পিপাসা থেকে বাঁচার জন্য, পাগল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য লড়াই করছি।আমরা যেভাবে পারি বাঁচতে চেষ্টা করছি। আমরা বাস্তুচ্যুতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি- আমার জীবনে আমি চারটি বাড়িতে থেকেছি এবং প্রতিটি বাড়িই ইসরাইলি বাহিনীর বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছে। আমাদের থাকার জন্য কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। যুদ্ধবিরতির আগে আমরা ৫০০ দিন সন্ত্রাসী তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি।দুর্ভাগ্যবশত যুদ্ধের সময় আমি যা করিনি, তা হলো কান্না। আমি দৃঢ় থাকার চেষ্টা করেছি এবং আমার দুঃখ এবং রাগ ভেতরেই রেখেছি, যা আমার হৃদয়কে ক্লান্ত করে তুলেছে এবং আরও দুর্বল করে দিয়েছে।আমি আমার চারপাশের সবার প্রতি ইতিবাচক ও সমর্থন যোগানো ব্যক্তি ছিলাম। হ্যাঁ, উত্তরের লোকেরা ফিরে আসবে। হ্যাঁ, সেনাবাহিনী নেটজারিম থেকে ফিরে যাবে। এভাবেই আমি সবাইকে শক্তি দিতে চেয়েছিলাম, যদিও আমার ভেতরে একটা বিরাট দুর্বলতা ছিল যা আমি দেখাতে চাইনি।আমার মনে হয়েছিল যে, যদি তা দেখা যায়, তাহলে আমি এই ভয়াবহ যুদ্ধে মারা যাব।যুদ্ধবিরতি ছিল আমার বেঁচে থাকার জন্য বড় আশা। আমার মনে হয়েছিল যেন আমি সফল হয়েছি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। যখন লোকেরা ভাবছিল– যুদ্ধ কি আবার ফিরে আসবে? আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিলাম- না, আমার মনে হয় না এটি ফিরে আসবে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।কিন্তু যুদ্ধ আবার ফিরে এলো, আরও কাছাকাছি, আরও ভয়ংকরভাবে। আমি কখনো শেষ না হওয়া গোলাগুলির ফলে সৃষ্ট ক্রমাগত ভয়ের সঙ্গে বেঁচে ছিলাম। তারা আমাদের বিরুদ্ধে সব ধরের অস্ত্র ব্যবহার করেছে- রকেট, বিমান থেকে বোমা, ট্যাঙ্কের গোলা। ট্যাঙ্কগুলো গুলি চালাতে থাকে, নজরদারি ড্রোন উড়তে থাকে; সবকিছুই ভয়াবহ ছিল।রাত-দিন গোলাবর্ষণ, ড্রোনের শব্দ, ট্যাংকের গর্জন — আমি ঠিকমতো ঘুমাতেও পারি না। কখনো একটু চোখ লেগে আসলেও বিস্ফোরণের শব্দে উঠে দৌড় দেই, জানি না কোথায় যাচ্ছি — শুধু দৌড়াই।এই আতঙ্কে আমার হৃদয় কীভাবে টিকে আছে, জানি না।তাই আমি বন্ধুদের বলেছি, আমার গল্প বলো। যেন আমি কেবল একটা সংখ্যা না হয়ে যাই।ইসরাইলি সেনাবাহিনী আমার চারপাশের এলাকা ধ্বংস করে দেওয়ার সময় আমরা অসহনীয় দিন কাটাচ্ছি। এখানে এখনো অনেক পরিবার বাস করে। তারা চলে যেতে চায় না, কারণ বাস্তুচ্যুতি শারীরিক, আর্থিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্তিকর।আমার জীবনের গল্পআমার মনে আছে, আমাদের প্রথম বাস্তুচ্যুতিটি ছিল ২০০০ সালে। তখন আমার বয়স প্রায় ৮ বছর। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বুলডোজার খান ইউনিস ক্যাম্পে ঢুকে আমার মামার বাড়ি এবং আমার দাদার বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। তারপর কোনো কারণে তারা আমাদের বাড়িতে এসে থামে। এ কারণে আমরা চলে গেলাম। রমজান মাস ছিল এবং আমার বাবা-মা ভেবেছিলেন আমরা পরে ফিরে আসতে পারি। তারা আমাদের জন্য একটি জীর্ণ ঘরের খোলস খুঁজে পেয়েছিলেন। তারা সাময়িকভাবে এটা ভেবেছিলেন।আমরা আমাদের বাড়ি হারিয়েছি- এই বিষয়টি আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই আমি সেই বাড়িতে ফিরে যেতাম। কারণ সেখানে আমার দাদা-দাদির সঙ্গে আমাদের সমস্ত সুন্দর স্মৃতি ছিল। আমি সেখান থেকে কিছু জিনিসপত্র আমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যেতাম।ঈদের আগের রাতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িটা ভেঙে ফেলেছিল। আমি এবং আমার পরিবার ঈদুল ফিতরের প্রথম দিনে সেখানে গিয়েছিলাম। আমার মনে আছে, ধ্বংসস্তূপের ওপর ঈদ উদযাপন করেছিলাম, নতুন ঈদের পোশাক পরে।ইসরাইলি বাহিনী আমাদের কিছু রাখতে দেয় না। তারা আমাদের সবকিছুই ধ্বংস করে দেয়, আমাদের হৃদয়ে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই বাকি রাখে না। আমি জানি না, বিশ্ব যদি এই ভয়ঙ্কর বর্বর সেনাবাহিনীর হাত থেকে আমাদের না বাঁচায়, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের কী হবে! আমি জানি না, আমার হৃদয় আর এই অবিরাম ভয়ঙ্কর গোলাগুলি আর বোমার শব্দ সহ্য করতে পারবে কিনা।আমাকে কখনো ভুলে যেয়ো নাআমি আমার জীবনের জন্য কঠোর সংগ্রাম করেছি। একজন সাংবাদিক এবং শিক্ষক হিসেবে আমি ১০ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছি, নিজেকে উৎসর্গ করেছি। আমার ছাত্রদের আমি অনেক ভালোবাসি। আর সহকর্মীদের সঙ্গে আমার সুন্দর স্মৃতি আছে।গাজার জীবন কখনোই সহজ ছিল না, তবুও আমরা এই ভূখণ্ডকে অনেক ভালোবাসি। আমরা অন্য কোনো জায়গাকে ভালোবাসতে পারি না। অন্য কোনো বাড়িকে নিজের ঘর বলতে পারিনা।’