আরব আমিরাতে ছয় শিল্প গ্রুপের সম্পদের সন্ধান


আরব আমিরাতে ছয় শিল্প গ্রুপের সম্পদের সন্ধান
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার এবং তাদের ঘনিষ্ঠ ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপের জালিয়াতির ঘটনা ছয়টি সংস্থা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তদন্তে ছয়টি শিল্পগ্রুপের নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) সম্পদ ও বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অর্থসম্পদ দিয়ে তারা সেখানে নামে-বেনামে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের একজন সাবেক আত্মীয়ের নামেও সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের আরও অনেক নীতিনির্ধারক ও নেতার নামে দেশটিতে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার থেকে বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ইউএই-এর সঙ্গে যৌথ আইনি সহায়তা চুক্তি করা হচ্ছে। এতে দেশটি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। টাকা ফেরত আনার বিষয়টি এগিয়ে নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এখন আমিরাত সফর করছেন। সূত্র জানায়, আলোচ্য শিল্পগ্রুপ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সদ্য বিলুপ্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও সিআইডি। এসব সংস্থার তদন্তের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিক তদন্তে তাদের নামে-বেনামে আমিরাতে যেসব সম্পদ, বিনিয়োগ ও ব্যবসার তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলোর বিষয়ে আরও তদন্তের জন্য দেশটির কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তারা ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছে। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও পাচার করা সম্পদ ফেরানোর বিষয়ে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের প্রধান ড. আহসান এইচ মনসুর এখন দেশটি সফর করছেন। ইতোমধ্যে দেশটির মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ ইউএই-এর ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (ইউএই এফআইইউ) সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। সেখানে আন্তর্জাতিক যেসব এজেন্টের অফিস রয়েছে, তাদের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করবেন। এ বিষয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেন্ট্রাল ব্যাংক অব দি ইউএই-এর সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে গভর্নরের। এছাড়া তিনি স্থানীয় প্রবাসীদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। ওইসব বৈঠকে পাচার করা অর্থসম্পদের তথ্য সংগ্রহ এবং সেগুলো দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে সহযোগিতা চাইবেন তিনি।একাধিক সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও আরামিট গ্রুপের কর্ণধার সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের ইউএইতে ২২৮টি সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে। এগুলোর বেশির ভাগই অভিজাত ফ্ল্যাট। এসব ফ্ল্যাট কিনে তিনি সেগুলো আবার বেশি দামে বিক্রি করেছেন। দেশটিতে তার পরিবারের সদস্যদের নামে ফ্ল্যাট বেচাকেনার ব্যবসা রয়েছে। দেশটির হাউজিং কর্তৃপক্ষের নথি অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এসব সম্পদ সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো উদ্ধারের জন্য সরকার থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব সম্পদের বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ এবং অর্থ উদ্ধারের জন্য দেশটিতে যৌথ আইনি সহায়তার অনুরোধ বা এমএলএআর পাঠানো হচ্ছে। বিএফআইইউ থেকে এর খসড়া তৈরি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেশটিতে আরও সম্পদ থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সেগুলোর অনুসন্ধান করতে বিএফআইইউ আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করছে-এমন সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করেছে। তারা এখন সে বিষয়ে তদন্ত করছে।বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের নামে-বেনামে আমিরাতে সম্পদ, বিনিয়োগ ও ব্যবসার সন্ধান পাওয়া গেছে। ট্রেজ বেইড মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশটিতে তার ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। মূলত রপ্তানির মূল্য দেশে না এনে তিনি সেসব অর্থ পাচার করেছেন। পাচার করা অর্থে তিনি দেশটিতে শেল কোম্পানি (নিজের পরিচয় গোপন করে বা বেনামি কোম্পানি) গঠন করেছেন বলে সন্ধান পাওয়া গেছে। এ কোম্পানির মাধ্যমে তিনি দেশটির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অর্থাৎ একই মালিকের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কোম্পানি। ফলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে একই মালিকের কোম্পানিতে। এতে রপ্তানির মূল্য দেশে আসছে না যথাযথভাবে। এসব সম্পদ উদ্ধারের বিষয়ে দেশটিতে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলআর) পাঠানোর কাজ চলছে।একটি শিল্পগ্রুপের মালিকপক্ষের বিভিন্নজনের নামে দেশটিতে সম্পদ ও বিনিয়োগের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের নামে দেশটির একটি বড় শহরে বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মূল্য কমপক্ষে ১২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এছাড়া দেশটিতে তারা টাকা পাচার করে সেগুলো দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এসব অর্থসম্পদ উদ্ধারের জন্য দেশটিতে এমএলএআর পাঠানোর জন্য তৈরি করা হচ্ছে।সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম ও তার গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিস্ট ব্যক্তির নামে আমিরাতে সম্পদ ও পুঁজি বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। ওইসব বিনিয়োগ থেকে দেশটিতে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাদের পক্ষে ইউরোপের দেশ আলবেনিয়ায় পুঁজি বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নেওয়া হয়েছে। এরপর ওই দেশের নাগরিকত্বের পরিচয় ব্যবহার করে আমিরাতে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে।প্রয়াত ব্যবসায়ী কাজী শাহেদ আহমেদ জেমকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তার সন্তানরা গ্রুপের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বিদেশে টাকা পাচারের সঙ্গে জেমকম গ্রুপের নামও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদন্তে জেমকম গ্রুপের নামে আমিরাতে সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের সম্পদের বিষয়ে আরও তদন্ত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তদন্তে পাওয়া সম্পদ উদ্ধারে দেশটিতে এমএলআর পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেশটিতে ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় শেল কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে জানা গেছে।শেখ হাসিনা পরিবারের একজন সাবেক আত্মীয়ের নামেও দেশটিতে সম্পদ রয়েছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দেশ থেকে পাচার করা অর্থের একটি অংশের সুবিধাভোগী ছিলেন ওই আত্মীয়। ওইসব অর্থ দিয়ে তিনি সেখানে সম্পদ গড়েছেন। এসব সম্পদ উদ্ধারের জন্য আইনি প্রক্রিয়ার পথে হাঁটা হচ্ছে।বিএফআইইউ-এর প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১০টি দেশে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার করা হয়েছে। দেশগুলো হলো-কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীন। এসব দেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি কঠোমোর স্থায়ী রূপ দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে ১০টি দেশের সঙ্গে সরকার মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স চুক্তি (এমএলএটি) করার বিষয়টি এগিয়ে নিচ্ছে। এটি হলো এমন একধরনের চুক্তি, যার আওতায় পাচার সম্পদের তথ্য যেমন পাওয়া যায়, তেমনই পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে আইনি সহায়তা পাওয়া যায়।এমএলএআর পাঠানো হলে এবং তা সংশ্লিষ্ট দেশ গ্রহণ করলে ওই দেশ থেকে পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহের জন্য নিজস্ব কোনো সংস্থা বা চুক্তিভিত্তিক কোনো সংস্থাকে সহায়তা করা হয়। এ কারণে পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহ ও উদ্ধারের জন্য দুটিই করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক দেশেই এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স চুক্তি (এমএলএটি) কেবল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা-এ দুটি দেশের সঙ্গে হয়েছে। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে হয়নি। এ কারণে বেশি টাকা পাচার হয়েছে-এমন ১০টি দেশের সঙ্গে এ চুক্তি করার প্রচেষ্টা চলমান। এর মধ্যে মালয়েশিয়া ও আমিরাতের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স চুক্তি করার জন্য কপি পাঠানো হয়েছে। দেশ দুটি তাদের নিজস্ব আইনের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন চুক্তির কপি বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার চুক্তির কপি এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমিরাতের চুক্তির কপিটি ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ইউএইতে আরও আলোচনা করবেন। হংকং ও চীনে চুক্তির কপি পাঠানো হয়েছে। তারা সেটি পর্যালোচনা করে তাদের দেশের আইনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নতুন দুটি খসড়া চুক্তির কপি পাঠিয়েছে।বাংলাদেশের পক্ষে বিএফআইইউ ৮১টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে ইউএই রয়েছে। এর আওতায় বিএফআইইউ দেশটি থেকে তথ্য পাচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা এগমেন্ট গ্রুপের সদস্য দুটি দেশ। ফলে এগমেন্ট গ্রুপের মাধ্যমেও তথ্য পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ এগুলোকে কাজে লাগিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে।