আশুলিয়া গাজীপুরে বন্ধ পৌনে দুইশ কারখানা


শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার পরও তৈরি পোশাক খাতের শ্রম অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। শ্রমিকদের প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও নতুন নতুন দাবি সামনে আনা হচ্ছে। টানা ১৩তম দিনের মতো গতকাল বুধবারও আশুলিয়া এবং গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় কাজ না করে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। কালিয়াকৈরে বিগ বস নামের একটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতকারীরা। আগুন নেভাতে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে বাধা দেয় তারা। এ সময় কারখানাটির মালপত্র লুট করা হয়। এসব কারণে গতকাল ১৮৩ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ করা হয় ৫৪টি কারখানা। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ অর্থাৎ কাজ নেই তো মজুরিও নেই ধারায় বন্ধ হওয়া কারখানাগুলো যত দিন বন্ধ থাকবে ততদিনের মজুরি পাবেন না শ্রমিকরা। এ ঘোষণার পর গতকালই কাজে ফিরতে কারখানায় ভিড় করছেন সাধারণ শ্রমিকরা। তবে শ্রমিক পরিচয় দেওয়া কিছু ‘ষড়যন্ত্রকারী এবং বহিরাগতদের’ কারণে কারখানা খুলতে পারছেন না বলে জানায় মালিক কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, পোশাকশিল্পকে স্থায়ীভাবে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে প্রায় সব কারখানায় ২০ থেকে ২৫ জনের এজেন্ট নিয়োগ করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। বাইরের ইন্ধনে তারাই সাধারণ শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে কর্মবিরতি, হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে। শিল্পঅধ্যুষিত এলাকায় পোশাক কারখানায় বিক্ষোভ-ভাঙচুরের ঘটনায় গোটা এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সতর্কতা হিসেবে অনেক ভবনে বড় করে ব্যানার লেখা রয়েছে– ‘ইহা পোশাক কারখানা নয়।’ একই রকম ব্যানার পোশাকবহির্ভূত অন্যান্য শিল্প-কারখানায়ও ঝুলতে দেখা গেছে। এদিকে গতকাল পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এতে শ্রম অসন্তোষের পেছনের প্রকৃত ঘটনা জানতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন তিনি। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার কিংবা উদ্যোক্তা বা বিজিএমইএ সব পক্ষই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দু-এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে বলে আশা তার। ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ রাখার বিষয়ে তিনি জানান, শ্রমিকরা মজুরি থেকে বঞ্চিত হোক– এটা তারা চাননি। এ কারণে শ্রমিকদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে কাজে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন তারা। তবে বাধ্য হলে কারখানা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবেন– এ রকম সিদ্ধান্ত হয়েছে সর্বশেষ সমন্বয় সভায়। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় কমিটি শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে বুধবার সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসিফ মাহমুদ বলেন, আশুলিয়ায় পোশাক কারখানাগুলোতে আজ বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা দ্রুত পরিশোধে কারখানাগুলোর আবেদনে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত অর্থছাড়ের নির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকেও সরকারের পক্ষ থেকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। চলমান শ্রম অসন্তোষের বিষয়ে তিনি বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করা হবে। শ্রমিকদের দাবি শুনতে কমিটি গঠন করা হবে। তারা যেন একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিগুলো জানাতে পারে, সে জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত কেবিনেট বৈঠকেই শ্রম পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। এ কমিটি মাঠ পর্যায়ে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলবে। সরাসরি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সুনির্দিষ্ট করা হবে এবং তা সমাধান করা হবে। কমিটি সমস্যা বুঝে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের সঙ্গে কথা বলবে। বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম, সিনিয়র সহসভাপতি আবদুল্লাহিল রাকিবসহ অন্য নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ১৮৩ পোশাক কারখানা বন্ধ গত কয়েক দিনের মতো সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে গতকালও কারখানায় হাজিরা দিয়ে কাজ না করে বিক্ষোভ শুরু করে অনেক শ্রমিক। কোনো কোনো কারখানার ভেতর ভাঙচুরের চেষ্টা করে তারা। আবার কোনোটিতে দুপুরের খাবারের বিরতির পর আর কাজে ফেরেনি শ্রমিকরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আশুলিয়া-টঙ্গী সড়ক অবরোধ করে রাখে। এসব কারণে মোট ১৮৩টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ৫৪ কারখানা শ্রম আইনের ‘কাজ নেই তো বেতন নেই’ ধারায় বন্ধ করা হয়। বাকি কারখানাগুলো গাজীপুরসহ অন্যান্য এলাকায়। সরেজমিন সকাল ১০টার দিকে মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানা বন্ধ পাওয়া যায়। বন্ধের নোটিশ ঝুলছে কারখানা গেটে। নোটিশে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারার কথা উল্লেখ করা হয়। জানতে চাইলে কারখানার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবদুল গাফফার জানান, গত মঙ্গলবার সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও শ্রমিকরা হাজিরা দিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে যান। এ কারণে শ্রম আইনের ধারা অনুযায়ী কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সকালে অনেক শ্রমিক কাজে যোগ দিতে আসেন। সাধারণ শ্রমিকরা জানান, মজুরি না পেলে তারা বাড়ি ভাড়াসহ মাসের খরচ নিয়ে বিপদে পড়বেন। এ ভাবনা থেকে তারা কাজে যোগ দিতে চান। তবে নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। মেঙ্গো টেক্সটাইলের নিরাপত্তা কর্মকর্তা সানজু বখশী জানান, শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা নিয়মিত কাজেও যোগ দিয়েছে। তবে পাশের কারখানার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ইটপাটকেল ছোড়ার কারণে বাধ্য হয়ে তারাও কারখানা বন্ধ রেখেছেন। তবে এ এলাকার নাসা গ্রুপের এ জে সুপার টেক্সটাইল মিলে যথারীতি কাজ চলছে। নিরাপত্তারক্ষী জানান, মালিকরা শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নিয়েছেন। কারখানার পরিস্থিতি এখন শান্ত। শ্রমিকরা কাজ করছে। তবে আশুলিয়া এলাকার বড় একটি শিল্প গ্রুপের একজন সিনিয়র নির্বাহী পরিচালক বলেন, শ্রমিকরা তাদের ২১টি দাবির কথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এখন নতুন নতুন দাবি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনায় তারা ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিকের গতিবিধিতে নাশকতার ষড়যন্ত্র দেখেছেন। তারা বাইরের ইন্ধনে শ্রমিকদের আন্দোলনে উস্কানি দিচ্ছে। তিনি জানান, দুপুরে খাবারের বিরতির সময় শ্রমিকরা যখন প্রবেশ করছিলেন, তখন বাইরে থেকে আরও দুষ্কৃত এনে তারা কারখানার ভেতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছেন। তিনি বলেন, কাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও শিল্প এবং শ্রমিকের নিরাপত্তায় উদ্বেগ থেকে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন তারা। কালিয়াকৈরে বিগ বস কারখানায় আগুন বিভিন্ন দাবিতে গতকাল সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন গাজীপুরের চক্রবর্তী এলাকায় অবস্থিত বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা। কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের জিরানি ও কবীরপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেন তারা। এক পর্যায়ে তারা শ্রমিকদের তাদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। কোনো কোনো কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ দেনও। দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীরা পার্শ্ববর্তী গাজীপুর মহানগরের কাশিমপুর থানার ভবানীপুর এলাকার বিগ বস করপোরেশন কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু বিগ বসের শ্রমিকরা এতে সাড়া না দিয়ে কাজ চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা বিগ বস কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। ভেতর থেকে এ কারখানার শ্রমিকরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ সুযোগে বিগ বস কারখানার ভেতরে থাকা দুষ্কৃতকারীরা কারখানাটির গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দেয়। গুদামে কাপড় এবং রাসায়নিকসহ দাহ্য পদার্থ ছিল। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে গোডাউন। অনেক দূর থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে উত্তেজিত শ্রমিকরা বাধা দেয়। তারা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভাঙচুর করে। শ্রমিকদের বাধার মুখে তারা স্টেশনে ফিরে যায়। এ সময় দুষ্কৃতকারীরা আশপাশের এলাকার বাড়িঘর এবং দোকানপাটে লুটপাট করে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বিগ বসের কারখানার ম্যানেজার মোজাম্মেল হক টিপু বলেন, বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বেতন পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এক পর্যায়ে তারা বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালান। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা আমাদের কারখানায় আগুন দেন। ভাঙচুর ও লুটপাট করেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা তাশারফ হোসেন জানান, শ্রমিকদের বিক্ষোভের কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি। সাড়ে ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কাশিমপুর মেট্রো থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম বলেন, অগ্নিকাণ্ডে কারও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। বিক্ষুব্ধরা বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর করেছে। টঙ্গীতে ৫ কারখানায় ছু‌টি ঘোষণা গাজীপুরের টঙ্গীতে ১২ দফা দাবিতে যমুনা অ্যাপারেলস পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। টঙ্গীর মিলগেট এলাকায় বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় বহিরাগতদের মারধরে চার শ্রমিক আহত হয়েছেন। নিরাপত্তা প‌রি‌স্থি‌তি বিবেচনা করে ওই কারখানাসহ আশপাশের পাঁচটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এগুলো হলো– ড্রেসম্যান ফ্যাশনওয়্যার লিমিটেড, ব্রাভো অ্যাপারেলস ম্যানুফ্যাকচার লিমিটেড, গার্মেন্ট এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেড এবং এজি ড্রেসেস লিমিটেড। শিল্প পুলিশ ও কারখানা সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল থেকে আট কর্মকর্তার পদত্যাগসহ ১২ দফা দাবিতে কারখানার প্রধান ফটকের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন যমুনা অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা। এক পর্যায়ে তারা লোকজন জড়ো করতে পাশের গার্মেন্টে হামলা করে। (প্রতিবদনে তথ্য দিয়েছেন আশুলিয়া, গাজীপুর ও কালিয়াকৈর প্রতিনিধি)