ইলেকট্রনিক্স শিল্পের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত
অনলাইন নিউজ ডেক্স
অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে করপোরেট কর ও কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত ইলেকট্রনিক্স শিল্পের জন্য আত্মঘাতী হবে। সরকার ৪ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্বের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগকে ঝুঁকিতে ফেলছে। নতুন বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ করছে। ভোগ বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিবর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শিল্পকে চাপ দিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর যেই সংস্কৃতি তৈরি করছে, তা দেশের জন্য হিতে বিপরীত হবে। করপোরেট কর বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় খাতসংশ্লিষ্টরা বুধবার এসব কথা বলেছেন।
তার অভিমত-করপোরেট কর ও অগ্রিম আয়কর বাড়ানো ইলেকট্রনিক্স শিল্পের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণের সুদহার দ্বিগুণ, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমনিতেই শিল্প টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর বাড়ানো হলে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। কারণ ফ্রিজ, এসির কাঁচামাল পুরোটাই আমদানিনির্ভর। একমাত্র সরকারের নীতি সহায়তার ওপর ভর করেই দেশে ইলেকট্রনিক্স শিল্প গড়ে উঠেছিল। এখন আইএমএফের পরামর্শে ঢালাওভাবে শিল্পে করের বোঝা চাপিয়ে দিলে দেশের সব শিল্প পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আবারও দেশ আগের মতো আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে।
যমুনা ইলেকট্রনিক্সের পরিচালক (বিপণন) সেলিম উল্যা সেলিম বলন, ইলেকট্রনিক্স শিল্পে কর ছাড় দেওয়ার কারণেই আমদানিনির্ভর পণ্যগুলো এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছেছে ফ্রিজ, এসি। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়েছে। এখন কর বৃদ্ধির যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্য আত্মঘাতী হবে। যে হারে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে, তাতে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে, অন্যদিকে ক্রমাগত ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে। ফলে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিক্রিও কমতির দিকে। নতুন করে ট্যাক্স বাড়ালে তা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং বাজার আরও সঙ্কুচিত হবে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, একটা সময় ফ্রিজ, এসির মতো ইলেকট্রনিক্সসামগ্রী আমদানি নির্ভর ছিল। দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় সেই ইলেকট্রনিক্সসামগ্রী উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর। চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি জোগান দিচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে অবদান রাখা এই শিল্প দাঁড়াতে পেরেছে শুধুমাত্র নীতি সহায়তার কারণে। এখন শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর ও কর্পোরেট কর বাড়ানো হলে আমদানিকৃত ইলেকট্রনিক্সসামগ্রীর সঙ্গে ডিউটি গ্যাপ (শুল্কের পার্থক্য) থাকবে না। তাতে দেশীয় শিল্পের মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিল্পকে বিপদে ফেলবে।
ভিসতা ইলেকট্রনিক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোকমান হোসেন আকাশ বলেন, পৃথিবীর কোথাও উৎপাদনমুখী শিল্পে এত ভ্যাট-ট্যাক্স নেই, যতটা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশের করনীতি ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ন করছে। সাশ্রয়ী মূল্যে সেরা মানের পণ্য কেনা ভোক্তার অধিকার। কিন্তু রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে এনবিআর গবেষণা ছাড়া শিল্পের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়াচ্ছে। যা শিল্পকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তিনি আরও বলেন, নির্দ্বিধায় বলা যায়, করপোরেট কর বাড়ানোয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। যাদের বিনিয়োগ আছে বা উদীয়মান বিনিয়োগকারী তারা সম্প্রসারণে যাবে না। কারণ ব্যাংক ঋণের সুদহার, জ্বালানি ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে একদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই লোকসান সইতে না পেরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
২০০৯ সাল থেকে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের কর ছাড় দিয়ে আসছে এনবিআর। শিল্পের করপোরেট কর, কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর এবং উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট ছাড় দেওয়ায় দেশে ১২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ খাতে কাজ করছে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক। পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে গেছে দেশে ইলেকট্রনিক্স পণ্য। হুট করে অগ্রিম আয়কর বাড়ানোয় পণ্যের দাম বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, খুচরা যন্ত্রাংশসহ পূর্ণ ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, এয়ার কন্ডিশনার ও কম্প্রেসার তৈরির প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দিয়ে ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর এনবিআর একটি আদেশ জারি করে। সেই প্রজ্ঞাপনে শর্ত সাপেক্ষে ২০৩২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ইলেকট্রনিক্স শিল্পের করপোরেট কর ১০ শতাংশ করা হয়। উৎপাদনের তারিখ হতে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের আয়ের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো।
মঙ্গলবার জারি করা নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শর্ত সাপেক্ষে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের করহার ২০ শতাংশ করা হলো। তবে এই করহার ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর হবে এবং এই হার ২০৩২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। হ্রাসকৃত করহার সুবিধা পেতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেই শর্ত পালন করতে হবে, সেগুলো হচ্ছে-শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মোল্ড ও ডাইস তৈরি ক্ষমতা থাকতে হবে। নিজস্ব পলি ইউরোথিন ফোমিং প্ল্যান্ট, পাউডার কোটিং প্ল্যান্ট এবং সক্রিয় ইটিপি (বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট) থাকতে হবে। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত ২৫ বছর ধরে ইলেকট্রনিক্স শিল্প রেয়াতি করহার ভোগ করে আসছে। এখন সময় এসেছে শিল্পকে রাষ্ট্রের কর দেওয়ার। তাছাড়া উদ্যোক্তারা যাতে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করতে পারেন, সেজন্য আগেভাগেই করহার বাড়ানো হয়েছে। আদেশ জারি হলেও বর্ধিত আয়কর ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর হলেও আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর আদেশ জারির দিন থেকেই কার্যকর হবে। দু-এক দিনের মধ্যে অগ্রিম আয়করের আদেশ বা প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে। বর্ধিত করহারের কারণে সরকার অতিরিক্ত ৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন মহলে আলোচনায় বলে থাকেন দেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে এনবিআর যখন নীতিগত বা এনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তখন তারাই সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেন।
কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়ে ডিসেম্বরে অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, করছাড়ের মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়ার দিন এখন আর নেই। আমরা ৫০ বছর ধরে বহু শিশুকে করছাড় ও প্রণোদনা দিয়ে লালন করেছি। আর কতকাল শিশুকে লালন করব? যে শিশুকে এতদিন লালন-পালন করা হয়েছে, তারা এখন শারীরিকভাবে বড় হয়ে গেছে। তারা এখনো বলে, আমাদের সুরক্ষা দিন; কিন্তু সুরক্ষার দিন তো চলে গেছে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।