উত্তরপ্রদেশে মুসলিম যুবকদের ওপর ফের ‘গোরক্ষক’ বাহিনীর হামলা


উত্তরপ্রদেশে মুসলিম যুবকদের ওপর ফের ‘গোরক্ষক’ বাহিনীর হামলা
গাড়িতে গরুর মাংস বহন করা হচ্ছে, এই সন্দেহে ভারতের উত্তরপ্রদেশে চারজন মুসলিম যুবককে নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করেছে সেখানকার তথাকথিত ‘গোরক্ষক’ বাহিনীর লোকজন। আহত চারজনের মধ্যে তিনজনের অবস্থাই অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার রাজ্যের আলিগড় জেলায়। আহত যুবকরা সবাই ওই জেলার আটরাউলি শহরের বাসিন্দা।জেলা পুলিশ সূত্রে তাদের নাম আরবাজ, আকিল, কাদিম ও মুন্না খান বলে জানানো হয়েছে।এদিকে ওই যুবকদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের একাধিক ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে – যাতে দেখা যাচ্ছে হামলাকারীরা তাদের জামাকাপড় খুলে নিয়ে প্রায় নগ্ন করে পেটাচ্ছে।মারধর করার সময় কাস্তে বা কাটারির মতো ধারালো অস্ত্রশস্ত্র, লাঠিসোঁটা, রড এবং ইঁটও ব্যবহার করা হয়েছিল।আহত যুবকদের একজন আকিলের বাবা সালিম খান স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ভিডিও দেখলেই বুঝবেন কীভাবে ওদেরকে মারা হয়েছে – আমার সেটা বর্ণনা করার ভাষা নেই!আকিল এখন আলিগড় হাসপাতালে মৃত্যৃর সঙ্গে লড়ছে বলেও তিনি জানান।হামলার ঘটনা যে ঘটেছে, তার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে আলিগড় পুলিশের পক্ষ থেকেও।তবে তারা এখনও কাউকে গ্রেফতার করেনি – তবে গাড়িতে যে মাংস ছিল তার নমুনা সংগ্রহ করে সেটি কীসের মাংস, তা পরীক্ষা-করা সহ ‘সব অভিযোগে’র তদন্ত করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।বছর কয়েক আগেও বিশেষত উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই ‘গোরক্ষক’ বাহিনীগুলোর হামলা প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল – ‘বিফ’ বহন করার অভিযোগে তাদের হাতে বহু মুসলিম পশু খামারি ও ব্যবসায়ী প্রাণও হারিয়েছেন।এই বাহিনীগুলোতে মূলত বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী শক্তির সদস্যরাই থাকতেন – পুলিশ ও প্রশাসন এই মিলিশিয়াদের ঢালাও মদত দিত বলেও বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে।তবে সম্প্রতি তাদের কার্যকলাপে কিছুটা ভাঁটা পড়লেও আলিগড়ের ঘটনা বুঝিয়ে দিল গোরক্ষকরা এখনও হারিয়ে যায়নি।সালিম খান যে এফআইআর দাখিল করেছেন, তাতে বলা হয়েছে তার ছেলে আকিল-সহ চারজন আলিগড় শহরের ‘আল আম্মার ফ্রোজেন ফুডস মিট ফ্যাক্টরি’ থেকে মাংস কিনে নিজেদের পিক-আপ ট্রাকে চাপিয়ে ফিরছিল।সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ তাদের গাড়িটি সাধু আশ্রম মোড়ের কাছে থামানো হয়, যে জায়গাটি হরদুয়াগঞ্জ পুলিশ থানার খুব কাছেই।বাহিনীর লোকজন দাবি করে তাদের কাছে খবর আছে ওই গাড়িতে করে বিফ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সালিম খানের অভিযোগ অনুযায়ী, চার যুবককে গাড়ি থেকে টেনে নামানো হয় এবং তাদের মাংস কেনার রশিদও কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়।এফআইআরে আরও বলা হয়েছে, হামলাকারীরা না কি বলে মোটা টাকা পেলে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হবে।কিন্তু আকিল ও সঙ্গীরা তাতে রাজি না হওয়ায় তাদের গাড়ি ধাক্কা মেরে উল্টে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।কেড়ে নেওয়া হয় তাদের সবার মোবাইল ফোন ও টাকাপয়সা। তার আগে গাড়ির সব মাংস টান মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়।এরপরই শুরু হয় ওই চারজনের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন। পুলিশ থানা খুব কাছে হওয়া সত্ত্বেও ঘটনার এই পর্যায় পর্যন্ত ঘটনাস্থলে তাদের দেখাই মেলেনি।সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে আবার দেখা গেছে, পুলিশ এসে পৌঁছানোর পরও গণপিটুনি চলছে।এফআইআরে যে ১৩জন অভিযুক্তর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা রাজকুমার আরিয়া ও বিজেপি নেতা অর্জুন সিং-এর নাম রয়েছে।আলিগড় (গ্রামীণ) জেলার পুলিশ সুপার অমৃত জৈন যখন শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের এই ঘটনা নিয়ে ব্রিফ করছিলেন, তখনও তাকে ঘিরে একদল লোক ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে থাকে!পুলিশ সুপার জানান, আমরা জানতে পারি কিছু লোক পশু জবাই করে গাড়িতে মাংস নিয়ে যাচ্ছে – এই খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা তাদের গাড়ি আটকে মারধর করছে।তিনি দাবি করেন, খবর পেয়েই পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায় এবং গণপিটুনিতে জখম চারজন ব্যক্তিকে নিরাপদে সরিয়ে নেয় এবং তাদের দীনদয়াল উপাধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিতসার ব্যবস্থা করে।অমৃত জৈন আরও বলেন, সব অভিযোগেরই আমরা তদন্ত করছি – গাড়িতে কীসের মাংস নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তা জানতে একজন পশু চিকিতসককে ডেকে মাংসের স্যাম্পলও সংগ্রহ করা হয়েছে।পরিস্থিতি এখন শান্ত বলে দাবি করে পুলিশ সুপার জানান, হরদুয়াগঞ্জ থানায় ঘটনার মামলা নথিভুক্ত হয়েছে – তার ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত করবে ও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।আলিগড় জেলার সমাজবাদী পার্টি নেতা মনোজ যাদব দাবি করেছেন, হিন্দুদের জন্য পবিত্র গোমাতা বা গরু রক্ষার নামে এই সব গুন্ডাবাহিনী যা চালাচ্ছে সেটা চাঁদাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।তিনি জানান, রেজিস্টার্ড ফ্যাক্টরি থেকে বাফেলো বা মহিষের মাংস কিনে এই গরিব ব্যাপারিরা যখন ফেরেন, তখন এই স্বঘোষিত গোরক্ষকরা তাদের রাস্তা আটকে চাঁদা আদায় করেন – এটার সঙ্গে ধর্মরক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই, সবটাই ভয় দেখিয়ে টাকা তোলার কৌশল!