ওয়াজ মাহফিল হোক নবিজির তরিকায়


শীতের মৌসুম এলেই বাংলাদেশের শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে ওয়াজ মাহফিলের নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে পড়ে। আবহমানকাল ধরে মুসলিম সমাজে এটি প্রচলিত। এখান থেকে মুসলমানরা ইমান, আমলে বলীয়ান হওয়ার পাশাপাশি আদর্শ মুসলিম হওয়ার নানা দিকনির্দেশনা পান। অথচ বর্তমান সমাজে ওয়াজ মাহফিল হারিয়েছে পূর্বেকার রূপ-সৌন্দর্য ও নীতি এবং আদর্শগুলো। জ্ঞানগর্ভ, বিষয়ভিত্তিক, গঠনমূলক, যুক্তিনির্ভর এবং উত্তম পন্থায় আচরণের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে অজ্ঞতাপূর্ণ, অশ্লীল, উগ্রবাদী এবং বিদ্বেষমূলক আচরণ। প্রিয় নবি (সা.)-এর ওয়াজ-নসিহত করার পদ্ধতি তুলে ধরেছেন- মুফতি মুহাম্মাদ আল আমিন নূরী ‘ওয়াজ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ উপদেশ। পবিত্র কুরআনেও এ শব্দের ব্যবহার উপদেশ দেওয়ার অর্থেই ব্যবহার হয়েছে। মানবজাতির কাছে ইসলামের বার্তাকে সুন্দরভাবে এবং প্রজ্ঞার সঙ্গে উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সূরা নাহল-আয়াত : ১২৫)। একমাত্র রাসূল (সা.)-এর দেখানো পথে রয়েছে আলোচ্য আয়াতের প্রকৃত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও বাস্তবায়ন। ওয়াজ করার সুন্নাতগুলো ১. বয়ানের মজলিসে উপস্থিত হয়ে শ্রোতাদের অভিমুখী হয়ে সালাম দেওয়া। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : হাদিস-৫২৮১)। ২. দাঁড়িয়ে বয়ান করা। (তিরমিজি : হাদিস-২১৯১)। ৩. লাঠি হাতে বয়ান করা। (আল মুজামুল কাবির : হাদিস-৩৫৪, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক : হাদিস-৫২৫১)। ৪. আল্লাহতায়ালার হামদ দ্বারা বয়ান শুরু করা এবং তার যথাযোগ্য গুণকীর্তন করা। (মুসলিম : হাদিস-৮৬৪)। ৫. বয়ানে শাহাদাতাইন উচ্চারণ করা। (মুসলিম : হাদিস-৮৬৪, তিরমিজি : হাদিস-১১০৬)। ৬. বয়ানের শুরুতে রাসূল (সা.)-এর ওপর দরুদ পড়া। (তিরমিজি : হাদিস-৩৩৮০, মুসনাদে আহমাদ : হাদিস-৯৮৪৩)। ৭. কথা বলার আগে শ্রোতাদের থামিয়ে দেওয়া। (শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-৩৫২)। ৮. কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে বয়ান করা। বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনি পরিহার করা। তবে বুজুর্গদের সত্য ঘটনা উপদেশের জন্য বলাতে দোষ নেই। (বুখারি : হাদিস-৩২৩০, ২২৭২, আবু দাউদ : হাদিস-১১০২)। কথা এত লম্বা না করা, যা শ্রোতার বিরক্তির কারণ হয়। আবার এমন সংক্ষেপও না করা যা বুঝতে শ্রোতাদের কষ্ট হয়। তবে অবস্থাভেদে বয়ান দীর্ঘ করার অবকাশও আছে। (মুসলিম : হাদিস-৮৬৯, ২৮৯২, তিরমিজি : হাদিস-৩৬৪০)। ১. ধীরে ধীরে বয়ান করা, যেন শ্রোতারা তা বুঝতে ও মুখস্থ করে নিতে পারে। প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করা। (বুখারি : হাদিস-৩৫৬৭, ৯৪, মুসলিম : হাদিস-২৪৯৩)। ২. শ্রোতাদের মেধানুযায়ী বোধগম্য করে বয়ান করা। (আবু দাউদ : হাদিস-৪৭৬৬, বুখারি : হাদিস-৯৪)। ৩. হিকমত ও উত্তম কথার মাধ্যমে মধুর ও নম্রভাষায় বয়ান করা। তবে বক্তৃতার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সতর্ক করতে আওয়াজ উঁচু করা ও উত্তেজিত হওয়াতে দোষ নেই। বরং এটাও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা নাহল : আয়াত-১২৫, মুসলিম : হাদিস-৮৬৭, আবু দাউদ : হাদিস-৪৭৯৬)। ৪. জাওয়ামিউল কালিম অর্থাৎ কম শব্দ প্রয়োগে বেশি ভাব ও মর্ম ব্যক্ত করা যায় এমনভাবে বয়ান করা। (বুখারি : হাদিস-২৯৭৭, মুসলিম : হাদিস-৫২৩)। ৫. বয়ানে অশ্লীলতা ও অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করা। বরং সওয়াব হয় এমন কথাই বলা। (তিরমিজি : হাদিস-১৯৭৭, ২৩১৭, শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-৩৫২)। ৬. মুকতাযায়ে হাল অর্থাৎ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজন অনুপাতে কথা বলা। (মুসলিম : হাদিস-২৮৯২, মুসনাদে আহমাদ : হাদিস-২২৮৮৮)। ৭. মাঝে মধ্যে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। প্রয়োজনে আলাদা আলাদাভাবে সম্বোধন করা। (বুখারি : হাদিস-৩৮৪৮, শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-৩৫২)। ৮. কথার গুরুত্ব বুঝাতে প্রয়োজনে কসম খাওয়া। (বুখারি : হাদিস-১৯০৪, মুসলিম : হাদিস-১১৫১)। ৯. প্রয়োজনে হাত নাড়িয়ে বয়ান করা। (শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-২২৬, সূরা কাফ : আয়াত-৩৭)। ১০. বিস্ময় বা গুরুত্ব বুঝাতে হাতের ওপর হাত মারা। (শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-২২৬, সূরা কাফ : আয়াত-৩৭)। ১১. বয়ানে মানুষদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর উপদেশ দেওয়া এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। (মাজমাউল আনহুর ১/১৬৮)। ১২. দোয়া ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে বয়ান সমাপ্ত করা। (তিরমিজি : হাদিস-৩৪৩৩)। ওয়াজ শোনার সুন্নাতগুলো ১. মনোযোগ দিয়ে ভালোভাবে দিলের কানে বয়ান শোনা। (শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-৩৫২)। ২. বয়ানের সময় কথাবার্তা না বলা, শ্রোতাদের মনোযোগ নষ্ট হয় এমন কাজ না করা। বরং চুপ-চাপ বয়ান শোনা। (শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-৩৫২)। ৩. বক্তার দিকে তাকিয়ে বয়ান শোনা। (সুনানে কুবরা, নাসাই (রহ.) : হাদিস-৫৭১৪)। ৪. কোনো ধরনের যুক্তি না দেখিয়ে কুরআন-সুন্নাহর বাণীকে নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া। (সূরা নিসা : আয়াত-৪৬)। ৫. আমলের নিয়তে শোনা। (সূরা নিসা : আয়াত-৪৬)। ৬. অপরের কাছে পৌঁছানোর নিয়তে শোনা। (বুখারি : হাদিস-১৭৩৯, মুসলিম : হাদিস-১৬৭৯)। ৭. আদবের সঙ্গে সুন্নাত তরিকায় বক্তার সামনে বসে শোনা। তবে দাঁড়িয়ে ও বাড়িতে শুয়ে শোনাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু এতে সরাসরি শ্রবণের বরকত লাভ হয় না। (মুসলিম : হাদিস-৮, আবু দাউদ : হাদিস-৪৬৯৫)। মাহফিল বা মজলিসের সুন্নাতগুলো ১. মজলিসে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সালাম দেওয়া। (তিরমিজি : হাদিস-২৭০৬, সহিহ ইবন হিব্বান : হাদিস-৪০৬)। ২. যেখানে জায়গা মিলে সেখানেই বসে যাওয়া। যদিও শেষ প্রান্তে হোক না কেন। (শামায়েলে তিরমিজি : হাদিস-৩১৯, তিরমিজি : হাদিস-২৭২৫)। ৩. কাউকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে না বসা। (বুখারি : হাদিস-৬২৬৯, মুসলিম : হাদিস-২১৭৭)। ৪. মজলিসে আগত ব্যক্তিদের জন্য জায়গা করে দেওয়া। কমপক্ষে তাদের সম্মানে একটু নড়েচড়ে বসা। (সূরা মুজাদালা : আয়াত-১১)। ৫. মজলিস আল্লাহর প্রশংসা, জিকির ও রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরুদ থেকে খালি না হওয়া (আবু দাউদ : হাদিস-৪৮৫৫, তিরমিজি : হাদিস-৩৩৮০, মুসনাদে আহমাদ : হাদিস-৯৮৪৩)। ৬. মজলিসে থাকাবস্থায় ইস্তিগফার করা। অর্থ : হে রব! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমার তাওবা কবুল করুন। কেননা, আপনি তাওবা কবুলকারী ও ক্ষমাকারী। আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা.) বলেন, আমরা একই মজলিসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ ইস্তিগফার ১০০ বার গণনা করতাম। (তিরমিজি : হাদিস-৩৪৩৪)। মজলিসের গোপন বিষয় প্রকাশ না করা ও গোপন বিষয় অনুমতি ছাড়া না শোনা। (আবু দাউদ : হাদিস-৪৮৬৮, বুখারি : হাদিস-৭০৪২, তিরমিজি : হাদিস-১৭৫১)। ৭. মজলিসে তিনজন থাকলে দুজন পরস্পর কানে কানে কথা না বলা। (বুখারি : হাদিস-৬২৯০, মুসলিম : হাদিস-২১৮৪)। ৮. মজলিস শেষে দোয়া পড়া। অর্থ : হে আল্লাহ! আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, আপনার প্রশংসার সঙ্গে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার কাছে তাওবা (প্রত্যাবর্তন) করছি। রাসূল (সা.) বলেন, মজলিস শেষে এ দোয়া পড়লে মজলিসের কৃত অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (তিরমিজি : হাদিস-৩৪৩৩)।