কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনে বিভ্রান্তি


ব্যাংক খাতের মৌলিক নীতিগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘন ঘন পরিবর্তন আনার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। গত জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের নীতিতে একাধিকবার পরিবর্তন এনেছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোও ঘন ঘন সুদহারে পরিবর্তন এনেছে। ফলে রপ্তানিকারক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও আমানতকারীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের হিসাব রাখার ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে ডলার সংকটের শুরু থেকে এর দাম নির্ধারণের বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন করেছে। এতে ডলারের দামে কোনো স্থিতিশীলতা ফেরেনি। নির্ধারিত দামে ডলারও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে নীতি পরিবর্তনের কোনো সুফল তো মেলেইনি। উলটো বিভ্রান্তির ফলে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট যেমন প্রকট হয়েছে, তেমনি ডলারের সংকটও কাটেনি। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোকে পরিচালনার স্থায়ী একটি নীতিমালা দরকার। ওই নীতিমালার বিষয়েও ব্যাংকগুলো তাদের নীতির পরিবর্তন করবে সময় সময়। তাহলে গ্রাহকরা যেমন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা বুঝতে পারবে, তেমনি ব্যাংকগুলো বুঝবে কখন কি করতে হবে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া ব্যাংকগুলো পরিচালনা বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। যেমনটি এখন চলছে। সূত্র জানায়, করোনার আগে থেকে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়। ২০২২ সালে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনার সময় সংস্থাটি সুদের হারের সীমা তুলে দিয়ে বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেয়। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের আওতায় সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। ওই সময়ে বাণিজ্যিক, ভোক্তাসহ কিছু খাতে ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে করিডর ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সরকারের ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের সঙ্গে নির্ধারিত অংশ যোগ করে সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করে। শুরুতে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। প্রতি মাসেই এ হার বাড়তে থাকে। এ কারণে সুদের হারও বাড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারিতে ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়ে ডাবল ডিজিটে পৌঁছে যায়। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভিত্তি সুদে আবার পরিবর্তন আনে। ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে আগে সাধারণ ঋণে সাড়ে ৩ শতাংশ, ভোক্তা ঋণে সাড়ে ৪ শতাংশ, কৃষি, পল্লী ও রপ্তানি খাতের প্রি-শিপমেন্ট ঋণের সঙ্গে আড়াই শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হতো। ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়ায় ভিত্তি সুদের হার দশমিক ৫০ শতাংশ কমানো হয়। এতে সাধারণ ঋণের সঙ্গে ৩ শতাংশ, ভোক্তা ঋণের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ সার্ভিস চাজ হিসাবে মোট ৪ শতাংশ, রপ্তানি খাতের প্রি-শিপমেন্ট ঋণ, কৃষি ও পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ যোগ করে নতুন সুদহার নির্ধারণ করতে থাকে ব্যাংকগুলো। এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এর ভিত্তিতে সুদহার নির্ধারণ করেছে। ফলে ঋণের সুদহার বেড়ে সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে ওঠেছে। সাধারণ ঋণের সুদহার ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, পল্লী ও কৃষি ঋণের সুদহার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশে। প্রি-শিপমেন্ট ঋণের সুদহার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ভোক্তা ঋণের সুদহার ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে ওঠে। এক বছর পেরোনোর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। এবার সুদ করিডর থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহারকে বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেয়। যেটি কার্যকর করা হয় সঙ্গে সঙ্গেই। তবে ব্যাংকগুলো এখন সুদহার নির্ধারণ করেনি। এখনো আগের পদ্ধতিতে আরোপিত সুদহারেই কাজ করছে। নতুন নিয়মে সুদহার ঘোষণা করতে একটু সময় লাগে। কারণ এ হার প্রণয়ন করে বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে ঘোষণা করতে হবে। কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত জুলাই থেকে সুদহারের নীতিতে প্রতি মাসেই পরিবর্তন এসেছে। এতে ব্যাংকগুলো যেমন ঋণের সুদহার হিসাব করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে, তেমনি গ্রাহকরাও পড়েছেন। কারণ প্রতি মাসে সুদহার পরিবর্তন করার কারণে গ্রাহকদের সুদ ৬ মাস পরপর পরিবর্তন করতে হয়েছে। এতে ঋণের সুদহার ২ থেকে আড়াই শতাংশ বেড়েছে। এতে গ্রাহকরা বিরক্ত হয়েছেন। ঘন ঘন সুদ পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সঞ্চয় ও ঋণ প্রকল্পের সুদহার স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে তারা কোনো প্রসপেক্টাসও প্রকাশ করতে পারেনি। এদিকে গ্রাহকরা ঘন ঘন ঋণের সুদহারে পরিবর্তন আনায় দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা করতে পারেননি। ঋণের সুদহারে পরিবর্তন আসায় আমানতের সুদহারও ঘন ঘন পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারে পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে। বুধবার বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করে ঋণ বিতরণের মঞ্জুরি পত্রে সুদহার কত দফা ও কত শতাংশ বাড়বে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার শর্ত দিয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা খুশি। কারণ তারা এখন সুদের হারের একটি সীমা পাচ্ছেন। ফলে অপরিকল্পতভাবে যখন-তখন ব্যাংকগুলো আর সুদহার বাড়াতে পারবে না। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, এত ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন ঠিক হচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজনে নীতির পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু যার সঙ্গে সরাসরি গ্রাহক জড়িত ওইসব নীতি ঘন ঘন পরিবর্তন করলে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। কারণ গ্রাহকরা প্রতি মাসে সুদহারের খবর রাখেন না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত ৯ মাসে রপ্তানি ঋণের সুদের হার ঘন ঘন পরিবর্তন হয়েছে। ফলে একেকটি চালানের ক্ষেত্রে সুদের হার ছিল একেক ধরনের। সুদের হারের একটি সীমা থাকা দরকার। তাহলে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারবেন। ডলারের দামে নীতির পরিবর্তন : ২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই পরামর্শেই ডলারের দাম বাড়ানো বা কমানো হতো। এতে আইএমএফ আপত্তি করলে ডলারের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতেও ডলারের দাম নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ছিল। গত বছরের জুলাইয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণে ক্রলিং পেগ (একটি নির্দষ্ট সীমার মধ্যে ডলারের দাম বেঁধে দিয়ে ওঠানামার সুযোগ) পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। বুধবার থেকে এ পদ্ধতি চালু করা হয়। এ দিন ডলারের সর্বোচ্চ দর ১১৭ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো এর এক টাকা কম বা বেশি দামে ডলার বেচাকেনা করতে পারবে। এই দর কার্যকর হয় বৃহস্পতিবার থেকে। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই এই দর বেশি কার্যকর ছিল না বাজারে। কারণ ব্যাংকগুলোতে ডলারের প্রবাহ কম থাকার তারা বেশিরভাগ গ্রাহককে ওই দামে ডলার দেয়নি। বরং ব্যাংকগুলো আগাম ডলার বেচাকেনা করেছে ১২৫ থেকে ১২৯ টাকা দরে। কিছু ব্যাংক ১১৭ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা দরে ডলার বিক্রি করেছে। এদিকে কার্ব মার্কেটে বা খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকায় ওঠেছে। তবে দিনের শুরুতে ১২৩ টাকায়ও কিছু ডলার বেচাকেনা হয়েছে। বুধবার ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১১৭ টাকা। বুধবারের আগে ব্যাংকগুলোতে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা করে ডলার বেচাকেনার কথা ছিল। কিন্তু ওই দামেই খুবই কম ডলার বেচাকেনা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডলারের দাম ছিল ১২২ থেকে ১২৫ টাকা। কলমানির সুদহার চড়া : ঋণের সুদ ও ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পর দিনই কলমানির সুদহার আবার বেড়ে গেছে। এই দফায় সুদহার বেড়েছে দশমিক ৫০ শতাংশ। আগের দিন সর্বোচ্চ সুদ ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। বৃহস্পতিবার তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে। একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি ধারের সুদের হার বেড়ে ১৩ শতাংশে ওঠেছে। আগে এর হার ছিল সাড়ে ১১ শতাংশ। এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধার নেওয়ার প্রবণতা অব্যাহত আছে। তবে এ খাতে ধারের পরিমাণ কমেছে। তবে কলমানি থেকে বেড়েছে।