অপরিকল্পিত নগরায়ণে নির্বাসিত নির্মল পরিবেশ


বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে পরিবেশ দূষণে ভূমিকা রাখছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে কমে আসছে সবুজ এলাকা ও উন্মুক্ত স্থান। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার মোট আয়তনের ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশই কংক্রিট আচ্ছাদিত। বাকি এলাকার মধ্যে ৯ দশমিক ২ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত, ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান এবং ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ জলাভূমি। অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় ১৯৯৯ সালে সবুজ আচ্ছাদন ছিল ৮ দশমিক ৯৭ বর্গকিলোমিটার। ওই বছর রাজধানীর ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ এলাকা ছিল বৃক্ষ আচ্ছাদিত। পরের এক দশকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে ২০০৯ সালে সবুজ আচ্ছাদন পাওয়া যায় ১২ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। বছরটিতে রাজধানীর আয়তনের ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ জায়গায় গাছের উপস্থিতি নজরে আসে। কিন্তু পরের এক দশকে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। গবেষণা অনুযায়ী, যে কোনো শহর এলাকায় কংক্রিটের শতকরা হারের পরিমাণ হওয়া উচিত ৪০ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়া ২৫ শতাংশ সবুজ, ১৫ শতাংশ জলজ ও ১০ শতাংশ খোলা জায়গা থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। বিআইপির সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় জলজভূমি ও সবুজ এলাকার পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসার পাশাপাশি বেড়েছে কংক্রিটের আচ্ছাদন, যা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে যে, আর একটি ইটের ভার বহনেরও ক্ষমতা নেই ঢাকার।’ এমন পরিস্থিতি দেশের প্রায় সব নগর-শহরেই বিরাজমান। ইট-কংক্রিটের অবকাঠামো বৃদ্ধি, গাছপালা ও জলাধার কমে যাওয়ায় সবুজের সমারোহ বিলীন হয়ে ক্রমেই ধূসর হচ্ছে শহরগুলো। কংক্রিটের শহরগুলোতে বাড়ছে তাপমাত্রা। বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে নাগরিক জীবন ওষ্ঠাগত। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে, সেসব এলাকার তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা একটি জনবহুল শহর। এখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের জায়গা ও কর্মসংস্থান করতে গিয়ে প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। গাছপালা কমেছে। গরম থেকে বাঁচতে মানুষ এসি ব্যবহার করছে। এ শহরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম দায়ী গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভবন-অবকাঠামো। খোলা জায়গা নেই বললেই চলে। ভবনগুলো এত কাছাকাছি নির্মিত যে বায়ু চলাচল করতে পারে না। উন্মুক্ত পরিবেশে অট্টালিকা নির্মাণসামগ্রী রেখে পরিবেশ দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মাসের পর মাস ধরে নির্মাণকাজ চলাকালে সিমেন্ট-বালি-ভাঙা ইটের গুঁড়া-মাটির অংশবিশেষ বাতাসে মিশে দূষণ ছড়াচ্ছে। ত্রিপল-পলিথিন দিয়ে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রেখে, ইট ও পাথরে পানি ছিটিয়ে, সিমেন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করে নির্মাণকাজ করার বিধান থাকলেও অনেকের বিরুদ্ধে তা না মানার অভিযোগ রয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি সঞ্চয়ে বৃষ্টি প্রধান নিয়ামক হিসাবে বিবেচ্য। অনাবৃষ্টির এ কঠিন সময়ে ভবন নির্মাণে মাত্রাতিরিক্ত পানির উত্তোলন সমস্যাটিকে আরও কঠিন করে তুলছে। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেলেও ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির কমতি নেই। বিশাল আকারের ভবনের ভিত্তির কারণে পৃষ্ঠের পানিও নিচে নামতে পারে না। ভূপৃষ্ঠের পানি জমে জলাবদ্ধতা-বন্যা সৃষ্টি হলেও ভূগর্ভে তা পৌঁছুতে অক্ষম। তাছাড়া বেশকিছু শহরে সমুদ্রের লোনা পানি ব্যবহারে নগরবাসী অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে রোগে-শোকে সামাজিক জীবনপ্রবাহ। পরিবেশ দূষণ-বিদ্যুৎ সংকট-শব্দদূষণে নাকাল অবস্থায় নিপতিত নাগরিকরা। কোথাও কোনো প্রতিবাদে এ মুনাফালোভী ব্যক্তিদের ন্যূনতম কর্ণপাত নেই। জনগণের সব সোচ্চার উচ্চারণকে চরম অবহেলা ও অবজ্ঞার চোখে দেখা হচ্ছে। দেশব্যাপী গড়ে ওঠা এসব বহুতল ভবন নির্মাণকালে দুর্ঘটনা এড়ানোর যথাযথ ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। ফলে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রায়ই নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাচ্ছে না পথচারীরাও। আবার অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে বেঁচে আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থাগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে। উল্লেখ্য, সংকট উত্তরণের বিষয়টিকে তারা মোটেও আমলে নিচ্ছে না। উলটো জনগণের অর্থে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের খুশি করার জন্যই সংস্থাগুলো তৎপর। রাজউক-সিডিএসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে এসব বহুতল ভবন নির্মাণের উপযোগিতা যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া প্রায় অকার্যকর। পাশাপাশি দেশব্যাপী কোনো রকমের জায়গা ছাড় না দিয়ে ভবন নির্মাণের ফলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। অগ্নিদুর্ঘটনা, শর্ট সার্কিট, গ্যাস লিকেজসহ নানামুখী দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে। নগরীর অবকাঠামো এমন দাঁড়িয়েছে যে, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি চলাচল বা ফায়ার ফাইটারদের কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এতে সম্পদ ও প্রাণহানি বাড়ছে। ভবন নির্মাতাদের আকাশচুম্বী অর্থ ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্যে সবাই নিশ্চুপ। এ ধরনের যথেচ্ছাচার গণরোষের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি সর্বজনবিদিত যে, কোনো জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্রুত টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সার্বিক আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে শিল্পায়নের অপরিহার্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিল্পায়ন কোনো দেশে শুধু যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাই নয়; মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক মানদণ্ডে শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অনুপাত কম-বেশি ৫:১। এ ছাড়া মানব উন্নয়ন সূচক তথা প্রত্যাশিত আয়ু, শিশুমৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা, শিক্ষার হার, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য, মানবাধিকার, পরিবেশ, সামাজিক অধস্তনতা ইত্যাদি সবকিছুই এ শিল্পায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। উন্নত বিশ্বের উন্নয়নের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনায় পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের অবদান স্পষ্ট। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে শিল্প প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। শিল্পের সমাহারকে ঘিরে নগর-সভ্যতা বিস্তৃতির ধারণা অতি সুপরিচিত। কিন্তু অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ অনগ্রসর সমাজকে অধিকতর পর্যুদস্ত করে। পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের ঢল শহর-নগরকে বস্তিতে রূপান্তর করে। মূলত শিল্পে বিনিয়োগ শুধু রাজস্ব আয় বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে না; এটি আমদানি-রপ্তানি খাত থেকে শুরু করে দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার, ব্যাংক-বিমা, পরিবহণসহ প্রতিটি খাতের উন্নয়নে সহায়ক। উপার্জনক্ষম শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নেও শিল্পায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় কৃষি ও কৃষকই এদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ এবং মোট শ্রমশক্তির ৬০ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কৃষি সামাজিক কর্মকাণ্ডের এক বিশেষ ক্ষেত্র, যা জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, আয়ের সুযোগ সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা অপরিহার্য। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়-শিল্পায়ন, নগরায়ণ, নদীভাঙন, বসতি স্থাপন, রাস্তা-অবকাঠামো-ইটভাটা নির্মাণসহ নানা কারণে প্রতি বছর ৮০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ২১৯ হেক্টর আবাদি জমি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আবাদি জমিতে চলছে অট্টালিকা নির্মাণের মহোৎসব। প্রবাসী আয়ের বেশির ভাগ অর্থই ব্যয় হচ্ছে অট্টালিকা বা ফ্ল্যাট ক্রয়ে। ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এই অনুৎপাদনশীল কর্মযজ্ঞে বিনিয়োগ করছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের প্রধান উৎপাদনশীল খাত নাজুক হয়ে পড়বে। ফলে প্রচণ্ড হুমকিতে পড়বে জননিরাপত্তা। মোদ্দা কথা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ কাম্য নয়। ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়