বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পিছিয়ে


সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিশ্বায়নের যুগে র‌্যাংকিং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচিত করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি মূল্যবান হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পদ্ধতিগত মূল্যায়ন, যেমন উচ্চশিক্ষার গুণগত মান, গবেষণা আউটপুট এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসহ বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে র‌্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও দুর্বলতাগুলোকে দৃশ্যমান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ের শ্রেষ্ঠত্ব বিভিন্ন দেশের শীর্ষ মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেরাও তাদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি লাভ করে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে পরিকল্পনা তৈরি করে। সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ, গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা, গবেষণার মান, মানব কল্যাণে অবদান, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মান ও মূল্যায়নের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবছর র‌্যাংকিং প্রকাশ করে। এসব র‌্যাংকিংয়ের মানদণ্ডে কিছুটা তারতম্য থাকলেও মূল সূচকগুলো মৌলিকভাবে একইরকম। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ পাঁচটি মানদণ্ড-শিক্ষা, গবেষণা, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম অর্থাৎ শিল্পের সঙ্গে গবেষণাকর্মের বাণিজ্যিকীকরণের ওপর ভিত্তি করে র‌্যাংকিং প্রকাশ করে। স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েবমেট্রিক্স’ র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের কনটেন্ট, শীর্ষ গবেষক এবং সেরা গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশনের ওপর (ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ৫০ শতাংশ, টপ সাইটেড গবেষকদের ১০ শতাংশ এবং টপ সাইটেড প্রবন্ধ ৪০ শতাংশ হিসাবে বিবেচনা করে)। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’র সূচক চারটি-শিক্ষা, নিয়োগযোগ্যতা, যোগ্য শিক্ষকদের সংখ্যা ও গবেষণা (গবেষণা আউটপুট, উচ্চমানের প্রকাশনা, গবেষণার প্রভাব ও সাইটেশন)। বিশ্ববিখ্যাত ‘কোয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস’ (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে নয়টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়-প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি, নিয়োগকর্তাদের খ্যাতি, শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন, বিদেশি শিক্ষকের সংখ্যা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাফল্য এবং সাসটেইনেবিলিটি। প্রতিটি সূচকে স্কোর থাকে ১০০, অর্থাৎ নয়টি সূচকে সর্বমোট ৯০০ মার্কের গড়মান হিসাব করে সর্বোচ্চ অর্জিত মানের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং করা হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সামগ্রিক র‌্যাংকিং-২০২৪’-এ বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এমনকি ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ২০২৪’-এর আঞ্চলিক র‌্যাংকিং অনুযায়ী, এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এগিয়ে যাচ্ছে। কিউএস সূচকগুলোর গড়মান ১০০-এর মধ্যে ১০০ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ (৯৯.২) ও অক্সফোর্ড (৯৮.৯) বিশ্ববিদ্যালয় এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড (৯৮.৩) ও স্টানফোর্ড (৯৮.১) বিশ্ববিদ্যালয়। এশিয়া মহাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন-চীন, জাপান, কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মানের দিক থেকে উন্নত বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমান্তরালে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিচ্ছে সামনের কাতারে। সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চীনের ২৯টি, জাপানের ১৫টি, ভারতের ১১টি এবং পাকিস্তানের ২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যদিও কিউএস র‌্যাংকিংয়ে সেরা ৭০০-১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়), তবে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু সূচকে মান পেলেও সামগ্রিকভাবে গড়মান অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। সংগত কারণেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে বিভিন্ন মহলে নেতিবাচক প্রশ্ন উঠছে। উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ইউজিসি নিজেই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিংয়ে এমন পিছিয়ে থাকার কারণ আসলে কী? বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে স্কোরের একটি বড় অংশ গবেষণা দ্বারা নির্ণীত হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি বাড়ানো ও তা এগিয়ে নিতে হলে গবেষণার মাধ্যমে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি মূলত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকরা হচ্ছেন গবেষক। শিক্ষকদের অন্যতম কাজ হলো মৌলিক গবেষণা পরিচালনা করে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ক্রিটিক্যালি বিশ্লেষণ, নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব জ্ঞান বিতরণ করা। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার সংখ্যা ও মান আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগোতে পারছে না। এর একাধিক কারণও রয়েছে; যেমন-শিক্ষকদের পদোন্নতিতে মৌলিক গবেষণা বাধ্যতামূলক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা অনেক ক্ষেত্রেই শিথিল করছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতিতে সুসংহত কাঠামো ও যথাযথ মূল্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষাদানের সময়কে প্রাধান্য দিয়ে গবেষণাকে গৌণ করে ফেলা হয়েছে; যার প্রমাণ গবেষণাহীন এবং পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপকের সংখ্যা এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেহায়েত কম নয়, যা উদ্বেগজনক। এর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণার প্রতি অনীহা তৈরি হচ্ছে, যার প্রভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানে। পিএইচডি শুধু একটি ডিগ্রি নয়, একজন গবেষক বা শিক্ষকের গবেষণার প্রবেশদ্বারও বটে। উন্নত বিশ্বে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আউটপুট হলো গুণগত মানসম্পন্ন প্রকাশনা বা জার্নাল আর্টিক্যাল। মৌলিক ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রকাশনার সংখ্যা এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের যথাযথ সাইটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। সাইটেশন হলো কোনো গবেষণাপত্রে অন্য কোনো লেখক বা গবেষকের তথ্য রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা। গবেষণার কনটেন্ট, ধরন ও মৌলিকতা জার্নালের মান ও সাইটেশনে প্রভাব ফেলে। গবেষণা যত সমসাময়িক ও মৌলিক হবে, প্রকাশনা তত ভালো জার্নালে হবে এবং সাইটেশন তত বেশি হবে। অপরদিকে দুর্বল ও মানহীন আর্টিক্যাল আন্তর্জাতিক স্কোপাস ইনডেক্সড জার্নালে প্রকাশ করা দুরূহ ব্যাপার। কারণ, এসব জার্নালে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন এডিটোরিয়াল বোর্ড থাকে, প্রকাশনায় মানের ক্ষেত্রে তারা সর্বদাই আপসহীন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ জার্নাল আর্টিক্যাল পিয়ার রিভিউবিহীন দুর্বল প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত হয়, যেগুলো গুণগত মানের জার্নালে সাইটেশন হয় না বললেই চলে। ফলে এসব গবেষণালব্ধ প্রকাশনা দ্বারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে সাইটেশন অংশে স্কোর অর্জনে পিছিয়ে থাকছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও র‌্যাংকিংয়ে উন্নতির একটি নিয়ামক। বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষার মানদণ্ডে ন্যূনতম শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত থাকা উচিত ১:২০। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত এখন ১:৩৫ থেকে ১:৫০-এর মধ্যে। অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর কারণে শিক্ষকদের ওপর ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেনটেশন ইত্যাদি নেওয়ার চাপ বেশি; ফলে শিক্ষার মান নিচে নেমে যাচ্ছে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও অনুপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এ অনুপাত ও সংখ্যা দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার সক্ষমতা পরিমাপ করা হয়। কয়েক দশক আগেও দেশের প্রথম সারির সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতো, বর্তমানে এ সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। ওয়েবসাইটে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব, ভর্তি ও ভিসাসংক্রান্ত জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আধুনিক আবাসনের সমস্যা, বাংলা ভাষায় পাঠদান এবং আন্তর্জাতিক মানের কমিউনিকেশন সেল না থাকায় বিদেশি শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারাচ্ছে। উপরোক্ত কারণে বিদেশি ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষকের পরিমাণও কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। আধুনিক বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমি কার্যক্রম বিভাগীয় প্রধান এবং অনুষদীয় ডিনের কার্যালয় থেকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভাগীয় প্রধান এবং অনুষদীয় ডিনের কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য যোগ্য জনবলের অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে বিভিন্ন সূচকের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম অন্যতম। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের ওপর জরিপের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক খ্যাতি হিসাব করা হয়। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ধরনের কাজ হচ্ছে, গবেষকরা নতুন কোন গবেষণা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত-এগুলো জরিপের মাধ্যমে উঠে আসে। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগকর্তাদের সুনামও প্রাতিষ্ঠানিক খ্যাতির মতো অপরিহার্য নিয়ামক। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বিভিন্ন চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে জরিপের মাধ্যমে নিরূপণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও খ্যাতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যোগ্যতা খাটো করার কোনো সুযোগ নেই। বিদেশে ডিগ্রি অর্জনের সময় আমাদের দেশের গবেষকরা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে থাকেন না। সেখানে তাদের গবেষণার মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তাদের গবেষণা কাজের মাধ্যমে উন্নত দেশের ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন হলো, তারা একই মানের গবেষণা কেন দেশে বসে করতে পারছেন না? এর কারণ বিশ্লেষণ করলে ঘুরেফিরে একই কথা চলে আসে : দেশে গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় শিক্ষকদের মাঝে গবেষণার প্রতি উৎসাহ নেই, অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়ার মতো একাডেমিক নেতৃত্বদানকারী শিক্ষকও নেই। ফলে গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লিজেন্ডারি শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। কিছু শিক্ষক গবেষণার সঙ্গে জড়িত থাকলেও এবং তাদের গবেষণালব্ধ প্রকাশনা ভালো জার্নালে প্রকাশিত হলেও তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বড়জোর একটি ক্রেস্ট দেওয়া ছাড়া তেমন কোনো সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। টেকসই শিক্ষা পদ্ধতি ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে প্রভাব ফেলে। কিউএস র‌্যাংকিংয়ে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাসটেইনেবিলিটি অর্জনের সূচকগুলো হলো-পরিবেশগত প্রভাব (পরিবেশগত স্থায়িত্ব, পরিবেশগত শিক্ষা ও পরিবেশগত গবেষণা), সামাজিক প্রভাব (সমতা, জ্ঞান বিনিময়, শিক্ষার প্রভাব, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য ও সুস্থতা) ও সুশাসন (নৈতিকতা, নিয়োগের অনুশীলন, স্বচ্ছতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ)। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাবরই টেকসই শিক্ষা পদ্ধতির সূচকে খুব নিুমানের স্কোর অর্জন করে থাকে, যা র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিছিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, র‌্যাংকিংভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য থাকলেও বেশিরভাগই থাকে পুরোনো, নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। র‌্যাংকিংয়ে ভালো করার জন্য উন্নত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত তথ্য, যেমন-শিক্ষার্থীর সংখ্যা, বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা, প্রফেসর-লেকচারারের সংখ্যা, শিক্ষকের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, পড়াশোনার পদ্ধতি, সফল শিক্ষার্থীদের তালিকা, গবেষণার চিত্র, গবেষণা অবকাঠামো, শিক্ষকপ্রতি সাইটেশন ইত্যাদি সুচারুরূপে বিদ্যমান থাকে। সেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট কিছু চাকরির খবর আর সভা-সমাবেশের ছবি দিয়ে ভর্তি থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত ইমেইল পর্যন্ত অনেক সময় ভুল থাকে, আবার অনেক ইমেইলে যোগাযোগ করা হলে রেসপন্স পাওয়া যায় না, এমন কথাও প্রচলিত আছে। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে জায়গা পেতে হলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে চলবে না, শিক্ষার মান বজায় রাখার পাশাপাশি শিক্ষকদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে বর্তমান সময়ে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার আধুনিকায়নে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি, ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল প্রতিষ্ঠা, রিসার্স অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা, আউটকাম-বেসড এডুকেশন সিস্টেম চালু ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় (বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ, এনএসটি ফেলোশিপ, বিশেষ গবেষণা অনুদান), শিক্ষা মন্ত্রণালয় (ব্যানবেইস গবেষণা অনুদান), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (পিএইচডি/পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (বিশেষ অনুদান, ফেলোশিপ/বৃত্তি) থেকে গবেষণা অনুদান প্রদানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সরকারের এসব উদ্যোগ এবং বর্ধিত অনুদান অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার মতো। কিন্তু উপরে উল্লেখিত আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে উন্নীত হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলোর সমাধানে ইউজিসির নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ উদ্যোগের ভেতর নিুলিখিত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। একাডেমিক অবকাঠামো এবং কোর্স কারিকুলাম সময়ের সঙ্গে আধুনিকীকরণ করে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও মৌলিক গবেষণা পরিচালনার জন্য স্মার্ট ও ভার্চুয়াল ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, আধুনিক যন্ত্রপাতি সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি, দ্রুত গতির ইন্টারনেট, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, গবেষণা তহবিল বৃদ্ধি করা এবং অনুষদ সদস্যদের গবেষণায় উৎসাহিত করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক প্রোফাইলকে উন্নত করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টি শিক্ষকদের আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে বলে শিক্ষকরা মনে করছেন, যা ভবিষ্যতে শিক্ষকতার পেশায় ও উচ্চশিক্ষায় মেধাবীদের আসতে নিরুৎসাহিত করবে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সমন্বয়ে ইউজিসি এবং সরকারের অন্যান্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে উচ্চ স্কোর অর্জন সম্ভব হতে পারে। ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক : অধ্যাপক, একোয়াকালচার বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ড. মো. মেহেদী আলম : সহকারী অধ্যাপক, ফিশারি রিসোর্সেস কনজারভেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়