কোরআন তিলাওয়াত মুমিনের অন্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করে, যা তার বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও প্রকাশ পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সংবলিত কিতাব, যা সামঞ্জস্য এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের দেহ রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাদের দেহমন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।’ (সুরা : ঝুমার, আয়াত : ২৩)
নিম্নে কোরআন তিলাওয়াতকারীর বিশেষ ১০ মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হলো—
সর্বশেষ্ঠ মানুষ
সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আছে। সব শ্রেণি-পেশার লোকদের চেয়ে কোরআন শিক্ষা গ্রহণকারী ও শিক্ষা দানকারীরা সর্বশেষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিগণিত। উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যকে শেখায়।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০২৭)
কোরআন তিলাওয়াতকারী মুমিন মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতম
রাসুলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময় সাহাবায়ে কেরামকে নানা উদাহরণের মাধ্যমে দ্বিন শিক্ষা দিতেন। যেমন তিনি অন্য মুমিনের চেয়ে কোরআন তিলাওয়াতকারী মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময় শিক্ষা দিয়েছিলেন। আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মুমিন কোরআন তিলাওয়াত করে, সে হলো উত্রুজ্জা ফলের (কমলালেবুর) মতো। ফলটি সুগন্ধিযুক্ত এবং স্বাদও উত্তম। আর যে মুমিন কোরআন তিলাওয়াত করে না, তার উদাহরণ হলো খেজুরের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই, কিন্তু সুস্বাদু।
আর যে মুনাফিক কোরআন তিলাওয়াত করে, সে হলো রায়হানা (লতানো) ফুলের ন্যায়, যা সুগন্ধিযুক্ত, কিন্তু স্বাদ তিক্ত। যে মুনাফিক কোরআন তিলাওয়াত করে না, সে হলো মাকাল (লতানো লেবুজাতীয় তিক্ত) ফলের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদও তিক্ত।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৪২৭)
কোরআন তিলাওয়াতকারীর দুনিয়াবি মর্যাদা
কোরআনের জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তির মর্যাদা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে বৃদ্ধি পায়। নাফে বিন আব্দুল হারিস (রা.) উসফান নামক স্থানে উমর (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য গেলেন।
ওমর (রা.) তাঁকে কর্মকর্তা হিসেবে মক্কায় নিযুক্ত করেছিলেন। অতঃপর তিনি নাফেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি মক্কা ও তায়েফের উপত্যকাবাসীদের জন্য কাকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছ? তিনি বলেন, ইবনু আবজাকে। উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, কোন ইবনু আবজা? তিনি বলেন, আমাদের আজাদকৃত গোলামদের একজন। উমর (রা.) বললেন, ‘তুমি একজন ক্রীতদাসকে তাদের জন্য তোমার স্থলাভিষিক্ত করেছ?’ নাফে বলেন, ‘তিনি মহান আল্লাহর কিতাবের একজন বিজ্ঞ আলেম, ফারায়েজ শাস্ত্রেও অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ বিচারক।’ তখন উমর (রা.) বললেন, তোমাদের নবী (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘এই কিতাবের অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ অনেক জাতিকে মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং কোরআন পরিত্যাগকারীদের অবনত করেন।’
(ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২১৮)
উক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়, আল্লাহ প্রেরিত কোরআনের ওপর ঈমান ও আমলের বদৌলতে মানুষ উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারে। আর কোরআনবিমুখ হলে মানুষ উভয় জগতে হবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত।
আসমান ও জমিনে উচ্চ সম্মান অর্জন
কোরআন নিঃসন্দেহে ইহকাল ও পরকালে উচ্চ সম্মান অর্জনের সোপান। ফলে কোরআন তিলাওয়াতকারীর সুনাম আসমানে ও জমিনে ছড়িয়ে পড়ে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোরআন তিলাওয়াতকে তুমি আবশ্যক করে নাও। কেননা এটি তোমার জন্য জমিনে আলোকবর্তিকা ও আসমানে ধনভাণ্ডারস্বরূপ।’ (সহিহ ইবনু হিব্বান, হাদিস : ৩৬১)
গাফেলদের তালিকা থেকে মুক্তি
নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াতে ঈমান মজবুত হয়। অন্তরের মরিচা বিদূরিত হয়। এমনকি উদাসীনতার কুহক থেকে মুক্ত হয়ে সোচ্চার ও শক্তিশালী মুমিনে রূপান্তরিত হওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘...আর যে ব্যক্তি রাতে ১০০ আয়াত তিলাওয়াত করবে, গাফেলদের তালিকায় তার নাম লেখা হবে না অথবা তার নাম বিনয়ীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে।’
(সহিহ ইবনু খুজায়মাহ, হাদিস : ১১৪২)
তিলাওয়াতকারীর পাপ নেকিতে পরিবর্তিত হয়
পৃথিবীর বুকে এমন কোনো গ্রন্থ নেই, যা পাঠ করলে পাপ ক্ষমা করা হয় এবং তাদের কৃত পাপ নেকিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু কোরআন মাজিদ তিলাওয়াত করলে আল্লাহ তাকে সব গুনাহ থেকে মুক্ত করবেন। কেননা আল্লাহকে স্মরণের অন্যতম মাধ্যম হলো কোরআন নিয়ে আলোচনা করা। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো জনসমষ্টি আল্লাহকে স্মরণের উদ্দেশ্যে একত্র হয়, অতঃপর পৃথক হয়, তখন তাদেরকে বলা হয় তোমরা পাপ থেকে ক্ষমাকৃত অবস্থায় দণ্ডায়মান হও। কেননা তোমাদের পাপকে পুণ্য দিয়ে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ১২৪৭৬)
ঈমানি জ্যোতির বিকিরণ
জুমার দিন সুরা কাহফ তিলাওয়াত করলে এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত তার ঈমান শাণিত থাকে এবং এ সময়ের সব ফিতনা থেকে আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ তিলাওয়াত করে, তার ঈমানি জ্যোতির বিকিরণ থাকবে এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত।’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস : ৩৩৯২; সহিহুত তারগিব, হাদিস : ৭৩৬)
কোরআনের ধারক জাহান্নামে যাবে না
কোরআনের ধারক-পাঠক জাহান্নামে দগ্ধীভূত হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কোরআন পাঠ করো। আর বাড়িতে সংরক্ষিত কোরআন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে। কেননা আল্লাহ ওই অন্তরকে কখনো শাস্তি দেবেন না, যা কোরআনের সংরক্ষক।’ (দারেমি, হাদিস : ৩৩১৯)
সম্মানিত লেখক ফেরেশতাদের মর্যাদা লাভ
দক্ষ তিলাওয়াতকারী ও অদক্ষ তিলাওয়াতকারীর ভিন্ন ভিন্ন ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোরআনে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান লিপিকার ফেরেশতাদের সঙ্গে থাকবেন। আর যে ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করে, কিন্তু আটকে যায় এবং তার জন্য তিলাওয়াত কষ্টকর হয়, তবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকি আছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৯৩৭)
এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, যারা দক্ষতার সঙ্গে কোরআন তিলাওয়াত করতে সক্ষম তারা আমল লিপিবদ্ধকারী সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জন করবে।
জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ
কোরআন মাজিদ তিলাওয়াতকারীর জন্য জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা আছে। কোরআনের পাঠক আয়াত মুখস্থ রাখার সংখ্যা বরাবর জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করবেন। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোরআন অধ্যয়নকারীকে বলা হবে, কোরআন তিলাওয়াত করো এবং ওপরে উঠতে থাকো। দুনিয়ায় তুমি যেভাবে ধীরে-সুস্থে তিলাওয়াত করতে, সেভাবে তিলাওয়াত করো। কেননা তিলাওয়াতের শেষ আয়াত সংখ্যায় জান্নাতে তোমার বাসস্থান হবে।’
