খেলাপি ঋণ হ্রাসের পদক্ষেপ জানতে চায় আইএমএফ


খেলাপি ঋণ হ্রাসের পদক্ষেপ জানতে চায় আইএমএফ
ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় খেলাপি ঋণ কমানোর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ জানতে চায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। নানামুখী পদক্ষেপেও খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটা সুফল বয়ে আনবে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। এদিকে খেলাপি ঋণের আন্তর্জাতিক মানের সংজ্ঞার বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আইএমএফ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে রোববার একাধিক বৈঠক করেছে।সোমবার দুটি বৈঠক হয়েছে এবং আজও বৈঠক হবে। ঢাকায় আইএমএফ এবারের মিশন শুরুর আগে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য চেয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছে।তাতে এসব পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আইএমএফ-এর কাছে তুলে ধরার প্রস্তুতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির সময় সংস্থাটি খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত আরোপ করেছিল। ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর ১০ শতাংশের মধ্যে এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার শর্ত আরোপ করেছিল। ওই সময়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২০ শতাংশের ওপরে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৮ শতাংশের ওপরে।গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও খেলাপি ঋণ কমানোর রোডম্যাপ ঘোষণা করে। এ ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়। এই ঘোষণা ও আইএমএফ-এর শর্ত আরোপের পরও খেলাপি ঋণ কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। তখন খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা হতো না। অনেক তথ্যই গোপন রাখা হতো। তথ্য গোপন করেও খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হয়নি।গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে থাকে। আইএমএফ-এর চুক্তির আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ছিল ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ২০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ কমার পরিবর্তে বেড়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা, যা আগের মোট খেলাপি ঋণের চেয়ে বেশি। আগামী দিনে খেলাপি ঋণ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।২০২২ সালের ডিসেম্বরে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট ও টাকা পাচারের কারণে এখন বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। ওইসব ঋণ এখন খেলাপি হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই তাদের লুটপাটের চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। ওই ঋণ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে এখন সেগুলো খেলাপি হচ্ছে।সূত্র জানায়, খেলাপি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হয়ে যারা খেলাপি হয়েছে-এমন সব ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের খেলাপি ঋণ নবায়নে বিশেষ ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাচারের কারণে যেসব ঋণ খেলাপি হচ্ছে, সেগুলোর বিপরীতে জামানত বিক্রি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জামানত বিক্রি করে ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো টাকা পাচারকারীদের বন্ধকি জামানত বিক্রি করতে নিলামে তুলছে। ইতোমধ্যে সোনালী, ইসলামী, জনতা, ইউসিবি, ন্যাশনাল ব্যাংক বন্ধকী জামানতের নিলাম করছে। কিন্তু এতে ঋণের সমপরিমাণ অর্থ আদায় হচ্ছে না। তবে জামানত বিক্রি করে কিছু টাকা আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ গ্রাহক বা ঘটনা ভেদে সামান্য কমানো সম্ভব হচ্ছে।জামানত বিক্রির ক্ষেত্রে যেসব আইনগত সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সমাধানের জন্য আইন সংশোধন ও নতুন আইন করা হচ্ছে। পাচার করা টাকা ফেরানো সম্ভব হলে খেলাপি ঋণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাইছে।খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে ব্যাংকগুলোর ওপরও চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হলে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। আইএমএফ-এর সঙ্গে বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব উদ্যোগের কথা জানাবে।আইএমএফ-এর শর্তের কারণে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হয়। নতুন সংজ্ঞা এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। আগে কোনো ঋণের কিস্তি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ছয় মাস পর খেলাপি করা হতো। এখন তিন মাস পর খেলাপি করা হবে। এতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাবে। এ কারণে উদ্যোক্তারা খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞার বাস্তবায়ন আরও পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেছে। এ বিষয়টিও আইএমএফকে জানানো হবে।এদিকে আইএমএফ আশঙ্কা করছে, খেলাপি ঋণ যেভাবে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়তি সুদ আরোপ হতে পারে। এলসির ক্ষেত্রে গ্যারান্টি ফি আরোপ হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশকে নিজ উদ্যোগেই খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টেনে নিরাপদ মাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে।