গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে


গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে
দেশে গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা আজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, এ দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতা ও উন্নয়ন এবং নিজস্ব জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির অনন্য রূপকার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে তিনি শাহাদতবরণ করেছেন, সেই গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা আজও পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খুব শিগ্গিরই আমরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত দেখতে পাব-এই হোক জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকীতে আমাদের অঙ্গীকার। এই লক্ষ্যে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলার জন্য বিএনপির সব পর্যায়ের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান খালেদা জিয়া।বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় এক ভিডিও বার্তায় প্রধান অতিথি হিসাবে তিনি এসব কথা বলেন। এতে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভায় সভাপতিত্ব করেন।খালেদা জিয়া বলেন, প্রতিবছর মে মাসের এই দিনটি আমাদের পরিবারে আসে এক বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে। এই দিনে শুধু আমাদের পরিবার নয়, বরং পুরো দেশই বেদনার্ত ও অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অবিচ্ছেদ্য নাম শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। যে চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করে দেশের সঙ্গে তার নাম অবিচ্ছেদ্য করেছিলেন। সেই চট্টগ্রামেই এক সফল, সৎ, দূরদর্শী ও প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মনে রাখবেন, সবার জন্য গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধানের যে রাজনীতি শহীদ জিয়া রেখে গেছেন, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।’এদিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ ঘোষণা করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে বিবেচনা করে আমি মনে করি, ডিসেম্বরের আগে নির্বাচন করা সম্ভব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবারও আহ্বান জানাচ্ছি-জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করুন। ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোটের জন্য সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ ঘোষণা করুন। এখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জয় বা পরাজয়ের কোনো কিছু নেই। বরং স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়ে গণতন্ত্রকে বিজয়ী করুন।তিনি বলেন, দেশের জনগণ সরাসরি নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে লিখিত সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সংস্কারের ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলেরই তেমন কোনো আপত্তি নেই। তবে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সরকারের অযথাই কালক্ষেপণে আপত্তি রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন সংগঠনও এ ব্যাপারে আপত্তির কথা জানিয়েছে। আমরা মনে করি, প্রস্তাবিত সংস্কার শেষ করে তাদের ইনটেনশন যদি ভালো থাকে, গণতন্ত্রের পক্ষে থাকে, তবে আমাদের দাবি অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দেবে।তারেক রহমান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের কোনো যোগাযোগ নেই। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, সমস্যার ব্যাপারে অনেক উপদেষ্টা ওয়াকিবহাল নয়। তাদের কেউ কেউ অফিসে বসে ফাইলপত্র দেখে, সমস্যা চিহ্নিত করে হয়তো তা সমাধান করার চেষ্টা করছেন। জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছাড়া, প্রশাসন নির্ভর হয়ে, ফাইল ওয়ার্ক দিয়ে যদি সব সমস্যার সমাধান করা যেত, তাহলে নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দল, রাজনীতির দরকার হতো না। দেশের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। সরকার বা সরকারপ্রধানের চিন্তাচেতনা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে স্বৈরাচারের জন্ম হয়। রাষ্ট্র ও জনগণের ওপর যাতে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা না হয়, সেজন্য রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। জনগণের ভোট ও জবাবদিহির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা করা যায়।বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হয়েছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া এই সরকার হয়তো বৈধ। তবে এ সরকার কোনোভাবেই জবাবদিহিমূলক সরকার নয়। জনগণের কাছে এ সরকারের জবাবদিহির কোনো সুযোগ নেই। ১০ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেনি। ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে একধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। জনগণের ভোটে একটি স্থিতিশীল সরকার না থাকায় কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগও হচ্ছে না। ইতোমধ্যে শত শত শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। জনগণ তাদের সমস্যার কথা সরকারের কাছে তুলে ধরার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না।তারেক রহমান বলেন, শহীদ জিয়ার (সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান) রাষ্ট্রচিন্তা থেকে প্রত্যেক রাজনীতিকের জন্য একটি বার্তা আছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সফল হতে হলে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে হবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ আগে বিবেচনা করতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষকের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চাইলে শহীদ জিয়ার প্রতিটি সৈনিক, খালেদা জিয়ার প্রত্যেক কর্মীকে আমার আহ্বান-আপনারা জনগণের সঙ্গে থাকুন। জনগণকে অবশ্যই সঙ্গে রাখুন।শুধু বিএনপি নয়, অধিকাংশ দল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায় বলে উল্লেখ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার জাপানে এক বক্তৃতায় বলেছেন, একটিমাত্র দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হয়, তাহলে তাড়াহুড়ো করে সংস্কার করতে হবে। আমরা বলেছি, আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) উপদেষ্টা পরিষদ নিরপেক্ষ নয়। আপনার উপদেষ্টা পরিষদ সংস্কার করুন। এখানে দুজন ছাত্র উপদেষ্টা বসে আছে, তারা একটা দলের। আরেকজন উপদেষ্টা আছেন বিদেশ ভ্রমণ করেছেন ২০ বছর। এখন বাংলাদেশকে উদ্ধার করতে এসেছেন! তার (উপদেষ্টা) বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংস্থার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কী পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন জানি না। আরও কয়েকজন ফ্যাসিবাদের দোসর আপনার উপদেষ্টা পরিষদে আছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব সংস্কার এক সপ্তাহ থেকে এক মাসের মধ্যে করা সম্ভব। আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) যদি না পারেন, তাহলে আমাদের বলেন, আমরা করে দিই।’দলের প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী (ভার্চুয়াল), শিক্ষাবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান প্রমুখ। বক্তারা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে তার অবদান তুলে ধরেন। এ সময় জিয়াউর রহমানের ওপর নির্মিত একটি ভিডিও ডকুমেন্টরি প্রদর্শন করা হয়।