ঝুলে আছে পদোন্নতি, ডিসি নিয়োগ ও প্রত্যাহার


ঝুলে আছে পদোন্নতি, ডিসি নিয়োগ ও প্রত্যাহার
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ঝুলে আছে দুটি ব্যাচের পদোন্নতিসংক্রান্ত কার্যক্রম। দুই মাসেও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত বিসিএস (প্রশাসন ক্যাডার) ২৪তম ব্যাচের রিভিউ চূড়ান্ত হয়নি। জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফিটলিস্ট তৈরি ও অনুমোদনের পরও পদায়ন হচ্ছে না। যুগ্মসচিব হয়েও অনেকে এখনো ডিসি হিসাবে কাজ করছেন, তাদের প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মচারীদের বেশ কিছু দাবি ঝুলে আছে ৭-৮ মাস। বিষয়গুলো নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনোবেদনায় ভুগছেন। এছাড়া সরকারি কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী নেওয়া হলেও পরবর্তী করণীয় স্থির করতে পারছে না মন্ত্রণালয়। এতে একশ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান কোনো মন্তব্য করেননি। তবে মন্ত্রণালয়ের একজন উইং প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব সময় কাজ এক রকম গতিতে হয় না। কখনো দ্রুতগতিতে কাজ হয়, আবার কখনো একটু ধীরগতিতে আগাতে হয়। তাছাড়া সব কাজই চলমান বলতে পারেন। ঝটপট করে কোনো কাজ করলে অনেক সময় ভুলভ্রান্তি হয়। সেক্ষেত্রে বুঝেশুনে বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে চায় সরকার। কাজের গতি নেই এমন অভিযোগ কি সত্য-এমন প্রশ্নে এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, সব ফাইল চলমান। একেবারেই স্থবির বললে বাড়িয়ে বলা হবে, বলতে পারেন ধীরগতিতে এগোচ্ছে।সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান সরকারের সমর্থক বা অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা সঙ্গত কারণেই কম। দীর্ঘ সময় স্বৈরাচার শাসকের সঙ্গে সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করেছেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে তারা দলীয় আনুগত্য বেশি দেখিয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর বেআইনি আদেশ পালন করতে গিয়ে তারা সর্বসাধারণের কাছে অজনপ্রিয় হয়েছেন। গত ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিবাদের দোসর আমলাদের নিয়ে বিপাকে পড়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কারণ স্বৈরশাসকের সমর্থক সিংহভাগ কর্মকর্তাকে কোথাও পদায়ন করা যাচ্ছে না। তাদের পদায়ন করতে গেলে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সমালোচনা শুরু হয়। অথচ সরকারের দলনিরপেক্ষ এবং দক্ষ কর্মকর্তা দরকার। পদোন্নতি ছাড়া কর্মকর্তা পাওয়ার সুযোগ নেই।জানতে চাইলে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, বর্তমান জনপ্রশাসনে এযাবৎকালের দুর্বল প্রশাসন। মন্ত্রণালয়টির সব উইংয়ে যোগ্য ও দক্ষ লোক না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রমে শৈথিল্য বিরাজ করছে। সিদ্ধান্ত নিলে তার বিরোধিতা আসছে। ভয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, উপযুক্ত লোকদের যথাস্থানে নিয়োগ না দিলে স্থবিরতা কাটবে না। সেক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, নিয়োগ-পদোন্নতির জন্য উপদেষ্টা কমিটি বিগত ৫৪ বছর ছিল না। এই কমিটির কারণেও অনেক স্থবিরতা বিরাজ করছে। যারা কাউকে চেনেন না, জানেন না, কে যোগ্য বা কে অযোগ্য সে বিষয়ে যাদের কোনো ধারণাই নেই, তাদের দিয়ে কমিটি করার মানে কী? তারা প্রশাসন সম্পর্কে কী জানেন, কী বোঝেন। মনে রাখতে হবে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তার অভাবে এই স্থবিরতা। কারণ দক্ষ কর্মকর্তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্বও করেন না এবং কোনো বিষয় পাশ কাটিয়েও যান না। কর্মকর্তার সংকট পূরণে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের যুগ্মসচিবদের অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতির উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ধীরগতি বিরাজ করছে। পদোন্নতি-পূর্ব সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) সভা হচ্ছে না। ফলে এক রকম ঝুলে আছে ২০তম ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি এসএসবির কার্যক্রম। প্রায় একই পরিস্থিতিতে পড়েছে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩০তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য এক বছর আগে কার্যক্রম শুরু হলেও এসএসবি মিটিং হচ্ছে না।সংশ্লিষ্টরা জানান, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের মোট কর্মকর্তা ৩৪৪ জন। এর মধ্যে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৯৬ জন। বঞ্চিত হয়েছেন ১৮০ কর্মকর্তা। নিকট-অতীতে এক ব্যাচের এত কর্মকর্তা একসঙ্গে বঞ্চিত হওয়ার কোনো নজির নেই। বিষয়টি নিয়ে বঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে পদোন্নতি পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রায় ২ মাস হতে চলেছে কোনো ধরনের ইতিবাচত ফলাফল দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশ বঞ্চিত কর্মকর্তারা। ওই ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, ১৮০ জন সবাই কি ফ্যাসিবাদের দোসর?জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর নভেম্বর মাস থেকে ডিসির ফিটলিস্ট তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রায় তিন মাস যাবৎ ডিসির ফিটলিস্ট তৈরি করে এ সংক্রান্ত কমিটি। ব্যাপকভিত্তিক যাচাই-বাছাই করে শতাধিক কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করে তা গত ২৫ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। দুই মাস পর বৃহস্পতিবার তা অনুমোদন শেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফেরত এসেছে। একটি তালিকা অনুমোদনে সময় লেগেছে দুই মাস। এখন আবার পদোন্নতি ও পদায়নসংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কবে উপদেষ্টা কমিটিতে ওই তালিকা অনুমোদন হবে তা কেউ বলতে পারছে না। মাঠ প্রশাসনে বর্তমানে ডিসি হিসাবে আছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ কর্মকর্তা। এর মধ্যে ২১ জন ডিসি গত ২০ মার্চ যুগ্মসচিব হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাদের মাঠ থেকে প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগের কোনো উদ্যোগও নেই। ফলে ডিসি হিসাবে পোস্টিং প্রত্যাশীরা ক্ষুব্ধ। ২৪ ব্যাচের যে ২৬ কর্মকর্তা ডিসি হিসাবে কর্মরত এর মধ্যে ৫ জন যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত। তারা মাঠে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অস্বস্তিতে আছেন। এর মধ্যে খুলনা, নাটোর, জামালপুর, গাজীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডিসি পদোন্নতিবঞ্চিত।এদিকে সচিবালয়ে কর্মরত নন-ক্যাডার কর্মচারীদের পদনাম পরিবর্তনসহ চারটি দাবি গত ৭-৮ মাস ধরে ঝুলে আছে। তারা বারবার জনপ্রশাসন সচিব, ভূমি সচিব, অর্থ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইতোমধ্যে গত মার্চ মাসে কর্মচারীরা একবার সচিবালয়ের ভেতরে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েও প্রশাসনের আশ্বাসে তা থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা হতাশ। কর্মচারীরা বলছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজ স্থবির হয়ে পড়ছে।