ট্রাম্পের ২.০: পলিসি কী হবে, বহির্মুখী না অন্তর্মুখী?


সব জল্পনা-কল্পনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনেকটা ভূমিধ্বস জয় পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন মার্কিনিদের একাংশকে খুশি করলেও শঙ্কা তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বে, বিশেষ করে আমেরিকার অবন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে। এই শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার মূল কারণ অনুনমেয় ট্রাম্প নিজেই। তার বেপরোয়া আচরণ, আগ্রাসী ব্যক্তিত্ব ও লাগামহীন বক্তব্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। যেটি তার অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ পলিসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধর্তব্য। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টই নিজ দেশের মৌলিক কূটনীতি ও বিদেশ নীতির বাইরে বেরিয়ে একতরফা নিজের ইচ্ছামতো কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। ট্রাম্পকেও সেই পথেই হাঁটতে হবে। তবে সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত প্রণয়নে বাড়তি কিছু সুবিধা দেবে নি:সন্দেহে; যেটি তার আগের ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পাননি। একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সরাসরি নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরম্পরাগুলো। আন্তর্জাতিক বিশ্বে হ্যাজিমনি টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক-সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বি-মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার বলয়ের রাষ্ট্রগুলোকে কোনঠাসা করে রাখতে ইউরোপ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে নানা সহযোগিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে রাশিয়া। এশিয়ার অর্থনৈতিক দৈত্য চীনের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণও একবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র মাঝে মধ্যেই কোনো কোনো দেশে আক্রমণ করে বা মিত্র রাষ্ট্রকে আক্রমণে সহযোগিতা করে নিজেদের আধিপত্য জানান দেয়। যেমনটি বেশি বেশি করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। ওয়ার অর টেররের ছদ্মাবরণে তিনি আফগানিস্তান, ইরাকসহ কয়েকটি দেশে শতাব্দীর সেরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। এছাড়া স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেশন তত্ত্বের আলোকে যুক্তরাষ্ট্র ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের সম্ভাব্য শত্রু ধরে নিয়েছে। সেই আলোকে মার্কিন শাসকরা গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় যে-তারা মূলত নিজ স্বার্থে প্রায় অভিন্ন নীতি অনুস্মরণ করেন। কোনো দল সরাসরি যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়; আর কোনো দল পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মিত্র রাষ্ট্রকে যুদ্ধে সহযোগিতা করে। এতে তাদের দুই ধরনের লাভ। এক. বিশ্বকে এই বার্তা দেওয়া যে, কেউ যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের মিত্রদের বিপক্ষে গেলে আর রক্ষা নেই। দুই. অস্ত্র বাণিজ্য। এই লাভালাভের মধ্য দিয়ে নিজেদের হেজিমনি টিকিয়ে রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইরান-ইসরাইল সংঘাত, লেবানন-ইসরাইল সংঘাত ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ এই প্রক্রিয়ারই অংশ। এসব যুদ্ধে ইসরাইল-ইউক্রেনকে সহযোগিতা দিতে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে এসেছে। মুদ্রাস্ফীতি চরম মাত্রা ধারণ করেছে। বেকারত্ব বেড়েছে; নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে এবারের নির্বাচনে। ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ‘বদ্য উন্মাদ ও বেপরোয়া’ জেনেও মার্কিনিরা আবারও তাকে জিতিয়েছেন, এই আশায় যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি তিনি টেনে তুলবেন। বহির্বিশ্বে যুদ্ধে সহযোগিতাকে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মতো অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প না মেনে নিজ দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্মুখী হবেন তিনি। মার্কিনিরা ডেমোক্র্যাটদের ওপর কতটা ক্ষুব্ধ তা সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলের দিকে তাকালে সহজেই অনুমেয়। এবারের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে পেয়েছেন ৩১২টি। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৬টি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফল নির্ধারক ৭টি সুইং (দোদুল্যমান) স্টেটের সবগুলোতে জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘উইনার টেকস অল নীতি’ অনুযায়ী ৭ রাজ্যের ৯৩ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সবকটি বগলদাবা করেছেন ট্রাম্প। ২০১৬ সালে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে জয় পেলেও পপুলার ভোটে হেরেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার ইলেকটোরাল-পপুলার উভয় ক্ষেত্রে এগিয়ে থেকেই জয় পেয়েছেন। এসোসিয়েট প্রেসের খবর বলছে, ২৪ কোটি ৪০ লাখ ভোটারের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার ৮৮১ ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। আর প্রতিদ্বন্দ্বী হ্যারিস তার চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েছেন। তার ভোট সংখ্যা ৭ কোটি ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩১ ভোট। ট্রাম্প ও হ্যারিসের ভোটের ব্যবধান ২ শতাংশ। তাদের অনুপাত যথাক্রমে ৫০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ। প্রতিনিধি পরিষদের বাকি আসনগুলোর ফল ঘোষণা হলে ট্রাম্পের ভোট আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে তিনি বাইডেনের রেকর্ড ভাঙার সুযোগ পাবেন না। সর্বশেষ ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন আট কোটি ১২ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। এর বিপরীতে তখন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছিলেন সাত কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোট। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জরিপে দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হলেও আগের দুই নির্বাচনের মতো লড়াই হয়নি এবার। ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর প্রথম থেকেই এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। সিনেট, প্রতিনিধি পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ সব জায়গায়ই ট্রাম্পের দলের জয়জয়কার। অন্যদিকে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন বেচারি কমলা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল সিনেটে ৫২ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে; ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ৪৪ আসন। গভর্নরেও এগিয়ে রিপাবলিকানরা। ট্রাম্পের দল পেয়েছে ২৭ ও হ্যারিসের দল ২৩। সবশেষ মার্কিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে রিপাবলিকানরা। মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস বুধবার সন্ধ্যায় জানিয়েছে, রিপাবলিকানরা অ্যারিজোনায় জয়ের পরে ৪৩৫ সদস্যের প্রতিনিধি পরিষদে কমপক্ষে ২১৮টি আসন জিতেছেন। সিনেটে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রতিনিধি পরিষদেও তাদের আধিপত্য নিশ্চিত হওয়ায় কর ও ব্যয় সংকোচন, জ্বালানি খাতে নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের মতো একটি বিস্তৃত অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ পাবেন ট্রাম্প। এই ম্যান্ডেট ট্রাম্পকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করবে নি:সন্দেহে। তাকে আইন পাশে সিনেট কিংবা প্রতিনিধি পরিষদে নতজানু থাকতে হবে না। ট্রাম্পের নীতি কেমন হবে সেটি রিপাবলিকান হাউস স্পিকার মাইক জনসনের কথা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আক্রমনাত্মক নীতিতে এগোতে হতে চান। তিনি বড় হতে চান এবং আমরা এটি সম্পর্কে উত্তেজিত। আমরা তীব্র ধংসাত্মক মন নিয়ে খেলতে যাচ্ছি।’ বাইডেনের মেয়াদের গত দুই বছর কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ বিরোধীদল রিপাবলিকানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ সময় বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নে বাইডেন প্রস্তাব পাস করতে বাধার মুখে পড়েছেন। আর এবার ক্ষমতার অন্তত প্রথম দুই বছর ট্রাম্প অনেকটা বাধা ছাড়াই নিজের নির্বাচনি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সুযোগ পাবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কেবিনেট সাজানোর ক্ষেত্রেও আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন; এ ক্ষেত্রে তিনি নিজের আগ্রাসী নীতি বেছে নিচ্ছেন। মন্ত্রিসভায় ও হোয়াইট হাউসে যাদের বেছে নিচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই কট্টর রাশিয়া ও চীন বিরোধী। ট্রাম্প ইতোমধ্যেই জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিউইয়র্কের প্রতিনিধি এলিস স্টেফানিক এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে ফ্লোরিডার প্রতিনিধি মাইক ওয়াল্টজ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক পরিচালক জন র্যাটক্লিফ মনোনীত করেছেন। এ ছাড়া ফক্স নিউজের উপস্থাপক পিট হেগসেথ পরবর্তী প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং তার দীর্ঘদিনের বন্ধু স্টিভেন উইটকফকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ফেরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন রূপ দেবে। চলমান যুদ্ধসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সম্ভাব্য আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করতে পারেন ট্রাম্প। যেটি অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে গোটা বিশ্বে। নির্বাচনি প্রচারের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বড় বড় নীতি ও পরিকল্পনার কথা বলেছেন, কোনো কোনোটির বিস্তারিত প্রকাশ করেননি; যা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তার এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়েই সাধারণ আমেরিকানরা এবার তাকে ভোট দিয়েছে। ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থতা, ইউক্রেন-মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটে অকাতরে অর্থনৈতিক-সামরিক সহায়তা করে ডেমোক্র্যাট প্রশাসন যখন ব্যর্থ তখন নিজ দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব ধরে রাখতে একরোখা ও বিতর্কিত ট্রাম্পকেই বেছে নিয়েছেন মার্কিনিরা। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ নির্বাচনি প্রচারের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সমাপ্তি একদিনে ঘটাবেন। কীভাবে সম্ভব—এমন প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেননি ট্রাম্প। তবে চুক্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন। ট্রাম্পের দুজন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করে যাওয়া। তবে ইউক্রেনকে এই সমর্থন নিঃশর্ত হবে না। রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ইউক্রেন বসবে এমন শর্তেই তাদের সহায়তা দেওয়া হতে পারে। রাশিয়াকে এই প্রক্রিয়ায় আগ্রহী করে তোলার জন্য ন্যাটোকে ইউক্রেনের প্রবেশ ঝুলিয়ে রাখতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ওই দুজন উপদেষ্টা এও বলেন যে, রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনের সব ভূ-খণ্ড কিয়েভ ফেরত পাবে এই চিন্তা জেলেনস্কিকে বাদ দিতে হবে। এটি আলোচনার টেবিলে দরকষাকষির মাধ্যমে ঠিক হবে যে, তারা কতটুকু ভূ-খণ্ড ফেরত পাবে। ট্রাম্পের সমালোচক ডেমোক্র্যাটরা তাকে এই বলে সমালোচনা করেন যে, ভ্লাদিমির পুতিনের বিষয়ে তার যে এপ্রোচ তাতে মনে হয় তিনি ইউক্রেনকে তার হাতে তুলে দেবেন। এর মাধ্যমে গোটা ইউরোপ হুমকির মুখে পড়বে। তবে ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন, তিনি যুদ্ধ যুদ্ধটারই সমাপ্তি চান। মধ্যপ্রাচ্য নীতি ইউক্রেনের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যেও শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনি প্রচারে তিনি গাজায় ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ ও লেবাননে ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বন্ধের কথা বলেছিলেন। সেটি কীভাবে—সে বিষয়ে কিছুই বলেননি ট্রাম্প। তিনি বারবার বলেছেন, তিনি যদি জো বাইডেনের জায়গায় থাকতেন হামাস ইসরাইলকে আক্রমণ করত না। কারণ তিনি ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করতেন; যে কারণে ইসরাইলের হামলার প্রয়োজন হতো না। ধারণা করা হচ্ছে-ট্রাম্প আবারও ইরানকে নিয়ে আকমণাত্মক নীতি প্রয়োগ করবেন। তার প্রশাসন ইরানের সঙ্গে বৃহৎ শক্তিগুলোর সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে আসবে। ইরানের ওপর আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। সমালোচকরা বলছেন, ইরান নিয়ে ট্রাম্পের নীতি এই অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। চীন ও বাণিজ্য আগের মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায় ট্রাম্প চীনকে কৌশলগত প্রতিযোগী বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি চীনের বেশ কিছু পণ্য যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করে সেগুলোতে চড়া শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এর প্রতিউত্তরে চীনও মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছিল। পরবর্তীতে দুদেশের পক্ষ থেকে এই বিবাদের মিমাংসার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে জল ঢেলে দেয়—করোনার সময়কালে ট্রাম্পের সেই উক্তি, ‘কোভিড চীনা ভাইরাস’। ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে মেধাবী ও মারাত্মক বলে উল্লেখ করেন। এও বলেন, একজন কার্যকর নেতা যিনি ১৪০ কোটি মানুষকে এক হাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জিনপিংকে নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তিনি একজন একনায়ক। বাইডেন প্রশাসন চীনকে যুক্তরাষ্ট্রেরশক্তিশালী নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করত। তবে স্ব-শাসিত তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যেটি চীন মোটেও ভালো চোখে দেখে না। তারা তাইওয়ানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। গত অক্টোবরে নির্বাচনি প্রচারের সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, যদি তিনি হোয়াইট হাউসে ফিরতে পারেন তবে চীন তাইওয়ানকে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে তার বিরুদ্ধে নিজ দেশের সেনাদের ব্যবহার করবেন না। তবে চীনা পণ্যে শুল্ক আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত দেন তিনি। এটি তো সবারই জানা যে, বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের দুই বৃহৎ সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক একটা প্রতিযোগিতা চলছে। বাণিজ্য, তাইওয়ান ইস্যু, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুদেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) মনে করে-ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীন ঘিরে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি আবর্তিত হবে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র এসব ইস্যু দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি হবে না। ২০১৮ সালে চীন থেকে আমদানি পণ্যে ট্রাম্প প্রশাসন ২৫০ বিলিয়ন ডলার শুল্ক বসিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বাণিজ্য যুদ্ধ লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ট্রাম্প চীনের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কাজ করার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। গত আগস্টে ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, শির সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু চীনের কিন্তু এখনও মনে রয়েছে, তার শুল্ক নীতির কারণে বেইজিংকে ওই সময় বড় অংকের মাসুল গুণতে হয়েছিল। ট্রাম্প গর্বের সঙ্গে বলেছেন, কেউ চীন থেকে ব্যবসা করতে পারে না। আমি কিন্তু ঠিকই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বের করে নিয়ে এসেছি। ট্রাম্প বলেন, দেশের অর্থনীতি মজবুত করতে তিনি বিদেশি পণ্যে শুল্ক বাড়াবেন। সব ধরনের আমদানি পণ্যে তিনি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। তবে শুধু চীনা পণ্যে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসাবেন। এতে অনুমেয় যুক্তরাষ্ট্রে চীনের ব্যবসায় খড়স আসছে। ট্রাম্পের চীন নীতি নিয়ে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস থিংক ট্যাংকের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো জুশো কার্লজিকের মূল্যায়ন হচ্ছে—তিনি অনেক বেশি প্রত্যয়ী এবং অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই সামনের দিনগুলোতে জিনপিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে সেটি এখনই বলা মুশকিল। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সেই সঙ্গে আগামীতে এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট। তবে দুদেশের বৈরিতা যেহেতু দীর্ঘ সময়ের তাই প্রস্তুতিটা নিয়ে রাখছে চীনও। ধারণা করা হচ্ছে ট্রাম্পের এ বিজয় শি জিনপিংয়ের দেশকে একটি প্রযুক্তি শক্তিশালায় রূপান্তরিত করার পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যা বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। কেননা, সম্পত্তির মন্দা, ক্রমবর্ধমান সরকারী ঋণ, বেকারত্ব এবং করোনা মহামারী চীনের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে। যা এখন আরও বাড়তে পারে। কেননা, নিজের প্রথম মেয়াদে চীনা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন ট্রাম্প। পরবর্তীতে যা আরও বেড়েছে। এবারও তেমনটি করবেন বলেই মনে করেন চীন বিশ্লেষক বিল বিশপ। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস করা উচিত যে তিনি (ট্রাম্প) যখন শুল্ক নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি চীনকে তার বাণিজ্য চুক্তি প্রত্যাখ্যান করা হিসাবে দেখেন। কারণ তিনি মনে করেন চীন এবং কোভিডের কারণে ২০২০ সালের নির্বাচনে তাকে হারতে হয়েছিল।’ সবশেষে একটি প্রশ্ন এসেই যায়, মার্কিনিদের এতো বড় ম্যান্ডেটের মান রাখতে পারবেন তো ডোনাল্ড ট্রাম্প? নাকি গতবারের মতো অতিমাত্রায় আগ্রাসী নীতি অনুস্মরণ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন? মার্কিনিরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবার যে নি:শর্ত ম্যান্ডেট দিয়েছে সেটির মূল্য তিনি দিতে না পারলে বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য ও মোড়লিপনার অভিলাস চরম ঝুঁকির মুখে পড়বে, এই সরলীকরণ তো করাই যায়। ভ্লাদিমির পুতিনের ভূ-খন্ডগত সম্প্রসারণবাদ ও চীনের অর্থনৈতিক উচ্চাবিলাস যুক্তরাষ্ট্রকে চেপে ধরবে। লেখক: আতাউর রহমান সাংবাদিক ও লেখক।