দেড় লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের তোড়জোড়


চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে বিরাজ করছে ধীরগতি। প্রথম নয় মাসে বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও খরচ হয়নি। এরই মধ্যে আগামী জুনে শেষ হয়ে যাচ্ছে সময়। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) আওতায় তিন মাসে খরচ করতে হবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ লাখ ৩১ হাজার ৩২ কোটি এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৩৯ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এখন চলছে সেই অর্থ ব্যয়ের তোড়জোড়। এ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া আছে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। কিন্তু আরএডিপির বাস্তবায়ন বাড়াতে শেষ মুহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করে ব্যয় করতে গিয়ে সরকারি টাকার অপচয় হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, অর্থবছরের শুরু থেকেই স্বাভাবিক নিয়মে সবকিছু চলমান থাকলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এটা এক ধরনের আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ। সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল রশীদ সোমবার বলেন, বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে কাজ করার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে যে সময়ে যে কাজ করার কথা তা করা হয় না। শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের কাজ করা হলে অবশ্যই মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ফলে সরকারি অর্থের অপচয় হওয়ার শঙ্কা থাকে। তিনি আরও বলেন, সরকারি ক্রয় আইন এবং ক্রয় বিধিতে অর্থবছরের শুরুতেই ক্রয় পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে না। কোনো ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করা হলেও তা কাগজে-কলমে অলঙ্কার হিসাবে থাকে। এক্ষেত্রে যারা কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ যাদের দেখভাল করার দায়িত্ব তারাও দায়িত্বে অবহেলা করেন। তাই পুরো প্রক্রিয়াটাই ভালোভাবে কাজ করে না। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। আইএমইডি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সম্প্রতি প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করে সংশোধিত এডিপির আকার ধরা হয় ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এখন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের যে গতি এতে সংশোধিত এডিপির সর্বোচ্চ বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এখান থেকেও বড় অংশের বরাদ্দ অব্যবহৃত থাকতে পারে বলে মন করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি অর্থবছরের নয় মাস পেরিয়ে গেলেও আরএডিপি বাস্তবায়নে পিছিয়ে রয়েছে অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলোর মধ্যে এখনো ৩০ শতাংশের নিচে বাস্তবায়নের হার রয়েছে ১৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আরএডিপি। এছাড়া ৩০-এর ওপরে কিন্তু ৫০ শতাংশের নিচে আছে ২৮টি এবং ৫০ শতাংশের ওপরে রয়েছে ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আরএডিপি বাস্তবায়ন। সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছর নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের ৩৪টি প্রকল্পের বিপরীতে আরএডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬ হাজার ৮৩৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কিন্তু গত ৯ মাসে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শতভাগ বাস্তবায়ন চাইলে এখনো বাকি আছে প্রায় ৮৯ শতাংশ। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ৮ প্রকল্পে বরাদ্দ আছে ২৪২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা, বাস্তবায়ন হার ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এছাড়া একই অবস্থা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আরএডিপি, বাস্তবায়ন ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৪ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ২১ দশমিক ২২ শতাংশ। আরও আছে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ২১ দশমিক ৭১ শতাংশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ২১ শতাংশ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ আরএডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। পিছিয়ে থাকা আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হলো-জনপ্রশাসন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (থোকসহ) এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, এটা মূলত সিস্টেমের সমস্যা। কেননা প্রত্যেক বছরই একই চিত্র দেখা যায়। কেননা বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী অর্থছাড় হয় দেরিতে। প্রথমদিকে টাকা থাকে না বলে কাজও কম হয়। তবে এরই মধ্যে ঠিকাদাররা হয়তো ভৌত কাজগুলো করে ফেলে। শেষদিকে যখন অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় দেয় তখন বিলগুলো পরিশোধ করা হয়। ফলে মনে হতে পারে তিন মাসেই এত টাকা ব্যয় হলো কীভাবে। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মূলত পরিস্থিতি এ রকমই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপচয় বা কাজের মান নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই। কারণ কাজ হওয়ার পরই বিল দেওয়া হয়। সুতরাং শেষ সময়ে পুরো কাজ যে তড়িঘড়ি করে করা হয় বিষয়টি এমন নয়।