দেশের বিভিন্ন স্থানে গরমে তারতম্য যে কারণে


দেশ গত ১ এপ্রিল থেকে ২৭ দিন ধরে তাপপ্রবাহের দীর্ঘতম সময় প্রত্যক্ষ করছে এবং আবহাওয়া অফিস সতর্ক করেছে যে এ অবস্থা পরবর্তী মাসজুড়ে অব্যাহত থাকবে। দেশের আটটি বিভাগের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। এ পরিস্থিতিতে আরও তিন দিনের (বুধবার পর্যন্ত) হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে রাজশাহী ও ঈশ্বরদীতে ৪১ দশমিক ৫, যশোরে ৪১ দশমিক ৬ ও কুমারখারীতে ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রোববার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, ফেনী ও বান্দরবান জেলাসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তাপমাত্রা যদি ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়। তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয় যখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। আর অতি তীব্র হয় ৪২ ডিগ্রি বা এর বেশি হলে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ২৫টি জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে অতি তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত আছে। বাকিগুলোর ওপর নেই। অঞ্চলভেদে দেশের বিভিন্ন এলাকার তাপমাত্রার এ তারতম্য কেন? বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই তথ্য। কিছু এলাকায় ‘অতি’ উষ্ণতা: উষ্ণতম জেলা হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ওপর দিয়ে বর্তমানে মাঝারি থেকে অতি তীব্র মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে উঠলেও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গায়। শনিবার চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এপ্রিলের পুরোটা জুড়েই চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। সেইসঙ্গে রাজশাহীও এ তালিকায় আছে। মূলত ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বছরের এ সময়ে চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বরাবরই অসহনীয় তাপমাত্রা বিরাজ করে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ স্থানেই মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যের কিরণ বা রশ্মি লম্বালম্বিভাবে এসে পড়ে। অল্প কিছু এলাকায় বাঁকাভাবে পড়ে। আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বিশেষ করে এপ্রিলে সূর্য বাংলাদেশের ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়। এসময় আকাশ মেঘমুক্ত থাকে। আরও সহজ করে বলতে গেলে, এপ্রিল মাসে সূর্য থেকে দেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে; যার কারণে সূর্যের তাপ বেশি পড়ে এ অঞ্চলে। চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া এবং উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ এলাকার বাতাস উত্তপ্ত থাকার আরেকটি কারণ হলো ‘লু হাওয়া’। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের দিল্লি, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান। এসময় ওখানের তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। মল্লিক আরও বলেন, চুয়াডাঙ্গাসহ ওই সব জেলা দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ভারত থেকে যে গরম বাতাস বা লু হাওয়া প্রবেশ করে তা বাংলাদেশের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে একই প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথা হয়েছিল আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হকের। তখন তিনি এ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এভাবে যে- চুয়াডাঙ্গা, যশোর, চূয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, খুলনা এ অঞ্চলে বিস্তৃত সমভূমি রয়েছে। এছাড়া এ অঞ্চলের পশ্চিমে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ। সেখানেও বিশাল এলাকাজুড়ে সমভূমি। ফলে তাপমাত্রা প্রবাহের যে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে- পরিবহণ, পরিচলন এবং বিকিরণ- এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে সমভূমি হওয়ার কারণে এ অঞ্চল দিয়ে পরিবহণ পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহিত হয়। ফলে সরাসরি তাপ লাগার কারণে পুরো অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি থাকে। বরিশালে বেশি গরম অনুভূত হয় কেন: আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, শনিবার খুলনা বা রাজশাহী বিভাগের সব জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। সেখানকার কোনো জেলায় ৩৯ ডিগ্রির কমে কোনো তাপমাত্রা নেই। কিন্তু বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ এসব অঞ্চলের চেয়ে তাপমাত্রা অনেকটাই কম। মল্লিক আরও বলেন, কিন্তু বরিশালের তাপমাত্রা যশোর চুয়াডাঙ্গার চেয়ে একটু কম হলেও গরমের অনুভূতি খুবই বেশি। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় তাপমাত্রা এমনিতেও ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রির বেশি উঠে না। কিন্তু তাপমাত্রা কম থাকলেও গরমে সেখানে নাভিশ্বাস উঠে যায়।’ কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেন, বরিশাল অঞ্চলে প্রচুর নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর থাকার কারণে অনবরত বাষ্পায়ন হয়। তাছাড়া বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় ওখানের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি। মূলত বাতাসে যখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে, তখন গরমও বেশি অনুভূত হয়। এ প্রসঙ্গে ২০২৩ সালে নাজমুল হক ব্যাখ্যা করে বলেন, এখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমি যদি বাতাসে আরও ২০ শতাংশ জলীয় বাষ্প ঢুকিয়ে দেই, তাহলে ওই ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি না থেকে ৪১ বা ৪২ ডিগ্রিতে রূপ নিতে পারে। কিছু এলাকায় তাপমাত্রা সহনীয়: আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশের তিনটি বিভাগ তাপপ্রবাহের বাইরে; রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট। সেখানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম। যদিও শুক্রবার রংপুর বিভাগেরও বেশিরভাগ জেলার ওপর মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছিল। মূলত, যখন কোনো স্থানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকে, তখন সেই স্থানে মৃদু তাপপ্রবাহ বইছে বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই হিসেবে ওই তিন বিভাগের অনেক স্থানে কোনো তাপপ্রবাহ বইছে না। বরং সহনীয় মাত্রার গরম পড়ছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলাও তাপপ্রবাহের বাইরে বলে জানিয়েছেন তিনি। ওই তিন বিভাগের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম হওয়ার কারণও এগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান। এসব অঞ্চলে একদিকে যেমন আছে বিস্তীর্ণ হাওর, অপরদিকে আছে সুউচ্চ পাহাড়। মল্লিক বলেন, ময়মনসিংহ এলাকায় হাওড়ের মতো বিশাল জলাধার আছে। তাছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় ওখানে মাঝে মধ্যে বৃষ্টিপাত হয়। তাই তাপমাত্রা কম। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম ও সিলেটে নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় গরম কম অনুভূত হওয়ার এটা প্রধান কারণ। আর যদি বনাঞ্চলের হিসাব করি, ওই সব অঞ্চলে বনায়ন বেশি এবং আশপাশে জলাধার আছে। ‘বঙ্গোপসাগর থেকে যে জলীয় বাষ্প বাংলাদেশে প্রবেশ করে, সেটা পাহাড়ি এলাকায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন ওই জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাসের ঊর্ধ্বগমন ঘটে বা ওপরের দিকে যায়। তারপর ওই বাতাসের ভেতরে যে পানির কণা থাকে, তা ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে। মেঘ তৈরির পর তা পাহাড়ের সম্মুখভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায় ও তাপমাত্রা কমায়’- ব্যাখ্যা করেন তিনি।