দেশে খাদ্য নিরাপত্তায় মাছের অবদান


প্রতিবছর জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হয়ে আসছে। এ ধারাবাহিকতায় এবার ‘ভরবো মাছে মোদের দেশ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ৩০ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০২৪ পালিত হচ্ছে। আগে একটা ধারণা ছিল-জেলেরাই শুধু মাছ চাষ করবেন এবং তারাই মাছ বিক্রি করে জীবনধারণ করবেন। সেই প্রচলিত ধ্যানধারণা এখন আর নেই। এখন অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক ব্যাংক থেকে ঋণ এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামীণ কিংবা শহরতলীর জলাশয় এবং পুকুর, নালা, ডোবায়, ধানের জমি, এমনকি শহরের ছাদে নানা পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তারা এখন এক্ষেত্রে উদ্যোক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এর সঙ্গে পরিবারের নারী সদস্যরা সম্পৃক্ত হওয়ায় সমন্বিত প্রক্রিয়ায় মাছ চাষাবাদ করা হচ্ছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশ আজ মাছ উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, দেশের চাহিদা মিটিয়ে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানিও করা হচ্ছে। এছাড়া মৎস্য খাত এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নানা রেকর্ড অর্জন করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার-২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মিঠা পানির মাছ আহরণে বাংলাদেশ চীনকে টপকে বিশ্বে ২য় অবস্থানে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনের মিঠা পানির মৎস্য উৎপাদন ছিল ১.৪৬ মিলিয়ন টন এবং অবস্থান ছিল বিশ্বে ২য়। অপরদিকে বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১.২৫ মিলিয়ন টন এবং অবস্থান ছিল বিশ্বে ৩য়। বিগত দুই বছরে দেশে মিঠা পানির মৎস্য উৎপাদন ১.২৫ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১.৩২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে চীনের উৎপাদন ১.৪৬ মিলিয়ন টন থেকে কমে ১.১৬ মিলিয়ন টন হয়েছে। ফলে দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ চীনকে টপকে ২য় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, যা এ দেশের জন্য একটি অভাবনীয় সাফল্য। এছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, ক্রাস্টাশিয়ান্স উৎপাদনে বিশ্বে ৮ম স্থানে থাকা, সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম হওয়া এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ ও এশিয়ায় ৩য় স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। মৎস্য খাতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়ন এবং মৎস্য অধিদপ্তর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর/সংস্থার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বিশেষ করে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে ৫ দশমিক ৭১ লাখ টন, যা একক প্রজাতি হিসেবে মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ। এছাড়া বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। ইলিশ জাতীয় জীবনের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে। জিডিপিতে ইলিশের অবদান শতকরা ১ ভাগের বেশি। কর্মসংস্থানের হিসাবেও দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ইলিশসম্পদের সঙ্গে জড়িত। মা ইলিশ রক্ষার্থে প্রতিবছর অক্টোবরে ২২ দিন সারা দেশে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এ সময় মৎস্যজীবী ও জেলেদের ২২ দিনের জন্য ২৫ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা (চাল) প্রদান করা হয়। তাছাড়া জাটকা নিধন প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়নে ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোয় ৪ মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এ সময় মৎস্য আহরণে বিরত মৎস্যজীবী ও জেলেদের মাসিক ৪০ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি মাছ ধরা বন্ধের সময় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২,২৬,৮১৮টি জেলে পরিবারকে প্রায় ৯৮,৩৬২.৫৫ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য ভিজিএফ হিসাবে দেওয়া হয়েছে এবং গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ডিসেম্বর/২০২৩ পর্যন্ত ১২,৫৩,৭৭১টি জেলে পরিবারকে ৫২,৬২৪.৭৪ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য ভিজিএফ হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসাবে মৎস্যসম্পদ রক্ষায় প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার ধাপে মোট ৩০ দিন ক্ষতিকর কারেন্ট জাল ধ্বংসে কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও জেলে নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসাবে জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান প্রকল্পের আওতায় ১৬ লাখ জেলের নিবন্ধন করা হয় এবং ১৪ লাখ জেলের মাঝে নিবন্ধন কার্ড বিতরণ করা হয়। তাছাড়া বর্তমানে রাজস্ব খাতের আওতায় জেলেদের নিবন্ধন হালনাগাদ করা হচ্ছে। দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৮,০১,৩৭৭ জন। শিগগিরই দেড় লক্ষাধিক জেলের মাঝে কার্ড বিতরণ করা হবে। ইলিশ ছাড়াও দুই বছরে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে দেশি প্রজাতি (পাঙাশ, বোয়াল, আইড় ও অন্যান্য ছোট মাছ) এবং কার্পজাতীয় মাছ। এছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ টানা পাঁচ বছর বিশ্বে ৫ম স্থান ধরে রেখেছে। মাছ চাষ নিবিড়করণে মাছের খামার যান্ত্রিকীকরণ; প্রজাতি বহুমুখীকরণ; জলবায়ু সহনশীল মাছ চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ; চাহিদার নিরিখে সময়োপযোগী মাছ চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ; হ্যাচারিতে গুণগত মানসম্পন্ন পোনা/রেণু উৎপাদন; চাষি ও উদ্যোক্তাদের নিয়মিত ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানসহ মাছ চাষের উপকরণ বিতরণ; রোগ নিয়ন্ত্রণে ডিজিস সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম জোরদারকরণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এ অর্জনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া দেশে মাছ উৎপাদনের যে ধারা চলমান রয়েছে, তা আগামী দিনে থেমে যাওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে সরকারের লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালে মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০৪১ সালে ৮৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা, যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে প্রায় ১.৮ গুণ বেশি। এ পরিমাণ মাছ উৎপাদন করতে হলে মৎস্য খামার যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অনুষঙ্গ অত্যাধুনিক স্মার্ট স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি মৎস্যচাষ ও ব্যবস্থাপনার প্রতিটি পর্যায়ে ব্যবহার করতে হবে। মৎস্যচাষে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার, ইন্টারেনেটভিত্তিক মৎস্য খামার যান্ত্রিকীকরণ, মৎস্যচাষ প্রদর্শনী ও চাষি পর্যায়ে লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে মৎস্যচাষ বহুমুখীকরণ, মৎস্য অবতরণকেন্দ্র উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে সহব্যবস্থাপনা প্রচলন, মৎস্য আইন প্রয়োগ অধিকতর জোরদারকরণ, মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ ও মৎস্যজাতপণ্য বহুমুখীকরণসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৎস্য খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দপ্তর-সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি দেশের সমুদ্র এলাকায় সুনীল অর্থনীতির বিকাশ সাধন ও সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ‘গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্প’ শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়া সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ শীর্ষক একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে; যা সুনীল অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা সংযোজনের পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। শুধু মৎস্যসম্পদ উৎপাদনই নয়, এর পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও মৎস্য খাত অবদান রাখছে। বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ১ কোটি ৯৫ লাখ বা ১২ শতাংশ মানুষ মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। শুধু তাই নয়, দেশের জিডিপিতেও মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উল্লেখ্য, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২.৫৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে মৎস্য খাত দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কৃষিবিদ মো. সামছুল আলম : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় alam4162@gmail.com