দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ শুল্ক হ্রাসসহ ৫ সিদ্ধান্ত বাণিজ্য উপদেষ্টার


বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য কমাতে শুল্ক ও কাস্টম ডিউটি যৌক্তিককরণসহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা। অন্য সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন ও এলসি খোলার ‘অ্যাড কনফার্মেশন’ ফি হ্রাস এবং ব্যবসায়ীদের একক ঋণসীমা বৃদ্ধি। এছাড়া অত্যাবশ্যকীয় পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহমুখী শিল্পে পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর সেগুলো কার্যকর করতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। এরপর উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় পণ্যের মূল্য কমানো এবং পাকা রসিদের মাধ্যমে পাইকারি পর্যায়ে লেনদেনের জন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানান। সূত্রমতে, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ শুরু করেছে। তবে সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বয় করবেন বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন। সংশ্লিষ্টদের মতে, নিত্যপণ্যের মূল্য কমিয়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নে কতটা সুফল ভোক্তা পাবে, দেখার বিষয়। কারণ, কতিপয় ব্যবসায়ীচক্র এখনো সক্রিয় আছে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া উদ্যোগ অনেকটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে জুলাই-আগস্টে ব্যাংকগুলো ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ অঙ্ক ছিল সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আলোচিত সময়ে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যপণ্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। এখন গ্রাহক ও ব্যাংকের সম্পর্কের ভিত্তিতে নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে পারবে। তবে বিলাসী কিছু পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ টাকা জমা রাখার শর্ত বহাল রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছে একক ঋণসীমা ১৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ করার। এ উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময়মূল্য বৃদ্ধির কারণে একক ঋণসীমার হার বাড়ানো দরকার বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, উৎপাদনকারীদের সুরক্ষার লক্ষ্যে ডলারের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং একক ঋণসীমা বাড়ানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গ্যাস সংকটে চিনিসহ অতিনিত্যপণ্যে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমন কথা বলে আসছে ভোগ্য পণ্য উৎপাদন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এ নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে গ্যাস সংকটের বিষয় আলোচনায় ওঠে আসে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চরম গ্যাস সংকটের মুখে পড়ে অস্তিত্ব রক্ষা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ছে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের শিল্পগুলো। উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে একদিকে কর্মহীন এবং পণ্যের বাজার হারানোর শঙ্কায় ভুগছেন এসব শিল্পে কর্মরত কয়েক লাখ শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা। সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে এ শিল্প এলাকাকে সচল রাখতে হবে। কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি (বা.) লি. কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্যাস সংকটে প্রায় আড়াই মাস ধরে তাদের কারখানা বন্ধ আছে। ফলে সাবান ও প্রসাধনী উৎপাদন হচ্ছে না দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় এ শিল্পে। সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা, ঘাটতির সুযোগে দেশি বাজারে এসব পণ্য চোরাইভাবে প্রবেশ করবে। কর্ম হারাবে এ শিল্পের শ্রমিকরা। বর্তমানে প্রায় ৬৫ হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সূত্রে জানা যায়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহমুখী শিল্পে পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন ও পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এদিকে নিত্যপণ্যের মূল্য কমাতে কর ও শুল্ক কাঠামো পর্যালোচনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ইতোমধ্যে আলু ও পেঁয়াজের বাজারমূল্য সহনশীল পর্যায়ে আনার লক্ষ্যে গত ৬ সেপ্টেম্বর আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের কীটনাশক আমদানিতেও শুল্ক কমানো হয়েছে। এ নিয়ে পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এ সুবিধা বলবৎ থাকবে। আলু আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি (সিডি) ২৫ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া আগে পণ্যটির ওপর প্রযোজ্য ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া আমদানি পর্যায়ে পেঁয়াজের ওপর ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে কীটনাশকের ওপর প্রযোজ্য ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি সমুদয় রেগুলেটরি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। একাধিক আমদানিকারক জানান, সরকার আমদানি শুল্ক কমালেও এর সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের ২৬ সেপ্টেম্বরের তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি, অপরিশোধিত সয়াবিন ও পরিশোধিত পাম অয়েল এবং রসুনের মূল্য বেড়েছে। এর মধ্যে কেজিতে পরিশোধিত চিনি ৭.২৫ থেকে বেড়ে ৭০.২০ টাকা এবং কেজিতে ৬.৮৭ টাকা বেড়ে অপরিশোধিত চিনি ৫৮.৫৯ টাকায় উঠেছে। এছাড়া কেজিতে ৯.৫২ থেকে বেড়ে অপরিশোধিত সয়াবিনের মূল্য ১১৮.৩৫ টাকা, কেজিতে ৯.৭১ টাকা বেড়ে পরিশোধিত পামতেলের মূল্য ১২৪.১২ টাকা এবং রসুনের কেজি মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৬৭.০৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩২৪.৭৩ টাকা। দেশি বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে : এক সপ্তাহের ব্যবধানে সয়াবিনের লিটারে (খোলা) ৩.৫০ টাকা বেড়ে ১৫১ টাকা, পাম অয়েল (খোলা) লিটারে ৫ টাকা বেড়ে ১৪৩, চিনির কেজিতে ১.৫০ টাকা বেড়ে ১২৯ এবং আদার কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে ডিম ও ইলিশ নাগালের বাইরে চলে গেছে। ১৮০ টাকা গুনতে হচ্ছে এক ডজন ডিম কিনতে।