প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র এখন মরা খাল


প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র এখন মরা খাল
এক সময়ের গঙ্গার চেয়েও তিনগুণ প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদ এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। চৈত্র ও বৈশাখ মাসে হেঁটে পার হয় মানুষ। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি তীরে গড়ে ওঠা বন্দর, শহর ও সভ্যতা।এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় ব্রহ্মপুত্র নদের ২২৭ কিলোমিটার অংশের দুই হাজার ৭৬৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার খননকাজ। এ কাজটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২৬ শতাংশ কাজের পরই যেন মুখথুবড়ে পড়ে।বিআইডব্লিউটিএ’র দাবি, বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রকল্প কাজটি বিলম্বিত হচ্ছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদকাল গত বছর আরও এক বছর বাড়ানো হয় এবং খননকাজ আরও সম্প্রসারণে সমীক্ষা চালানোর দাবি করা হয়।শনিবার ওই প্রকল্পের আওতায় চলা কিশোরগঞ্জ অংশ পরিদর্শনকালে খনন কাজের কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলা ও ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মধ্যবর্তী খুরশিদ মহল সেতু এলাকায় কোনো খননকাজ চোখে পড়েনি। বরং চোখে পড়ে কিছু চরের মাটি কেটে নদী ভরাট করার কাজ। একইভাবে জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার মির্জাপুর বাজার এলাকায় দেখা যায় খননকাজ অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে।অথচ কথা ছিল কিশোরগঞ্জ অংশের খননকাজ শেষ হলে ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব বন্দর বাজার এলাকা পর্যন্ত নৌচলাচল স্বাভাবিক হওয়ার।এ সময় নদী তীরবর্তী এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, দেশের একসময়ের অন্যতম বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্র এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। স্থানে স্থানে চর আর বালুর পাহাড় জমে প্রমত্ত নদী পরিণত হয়েছে বালুমহালে। খনন কাজে গাফিলতি, তীর দখলের হিড়িক আর দূর উজানের উৎসপথে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ইত্যাদির প্রভাবে অসংখ্য চর নিয়ে কোনো রকমে প্রমত্তা রূপ হারিয়ে ও গতিহারা অবস্থায় বেঁচে আছে।ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদ-নদীগুলোও অস্তিত্ব হারিয়ে মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেও এসব শাখা নদ-নদীর অনেক স্থানে হাঁটুসমান পানিও মেলে না। ফলে ভেঙে পড়েছে সহজ ও কম খরচের নৌযোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা।কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, খনন কাজের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের নাব্য ফিরিয়ে আনা না হলে ব্রহ্মপুত্র নদ সৃষ্ট হয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ধনু নদীতে মিলিত হওয়া নরসুন্দা নদীটি অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নরসুন্দা নদীতে বড় ধরনের নতুন খনন প্রকল্প নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্রহ্মপুত্র নাব্য ফিরে পেলেই এ খনন প্রকল্পটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। চীন, ভারত ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র একটি আন্তঃদেশীয় নদ। তিব্বতের মানস সরোবরের নিকটবর্তী ‘চেমাইয়াংডু’ হিমবাহ থেকে উৎপত্তির পর এটি তিব্বত মালভূমির ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে মানপো নামে প্রায় এক হাজার মাইল প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে ঘুরে ৪৪২ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সাদিয়ার কাছে আসামে প্রবেশ করে। আসামের ‘ডিহাং’ এবং পরে ব্রহ্মপুত্র নামে পশ্চিম দিকে প্রায় ৪৫০ মাইল (প্রায় ৭২৪ কিলোমিটার) প্রবাহিত হওয়ার পর গারো পাহাড়ের কাছে দক্ষিণে ঘুরে বর্তমান কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। ব্রহ্মপুত্র কিছুদূর এগিয়ে দক্ষিণ অভিমুখী তিস্তায় মিলেছে। আরও দক্ষিণে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র বিভক্ত হয়ে এক শাখা যমুনা এবং অন্য শাখা ব্রহ্মপুত্র নামে জামালপুর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলা হয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। কুড়িগ্রাম থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্রের নৌপথ ভৈরব বাজারের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলেছে। এসব নৌপথ ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম।ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিনের মতে, আজকের মৃতপ্রায় ব্রহ্মপুত্র ত্রয়োদশ শতকে প্রশস্ততায় গঙ্গার তিনগুণ ছিল। সপ্তদশ শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণের সময় গঙ্গার চেয়ে তিনগুণ প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে কামরূপ গিয়েছিলেন।প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নদের খননকাজ পরিচালনা করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার ৭৬৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখ থেকে শুরু করে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ হয়ে গাজীপুর জেলার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার অংশে ১০০ মিটার প্রস্থ ও ৬ মিটার গভীরতা রেখে খনন করা হবে। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় রয়েছে ৯০ কিলোমিটার অংশ।বিআইডব্লিউটিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মহসীন মিয়া দাবি করেন, ‘করোনাকালসহ বেশ কিছু কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। নির্ধারিত সময়ে ৩৫ শতাংশ খননকাজ শেষ হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। আশা করছি এ সময়ের মধ্যে খননকাজ শেষ হবে। প্রকল্প পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, যমুনা নদীর সঙ্গে সংযোগস্থলটি ধীরে ধীরে কাটতে হবে। এ বিষয়ে সমীক্ষা করা হচ্ছে। সীমানা নিয়ে জটিলতা, অনেক স্থানে বাধা, প্রশাসনিক জটিলতাসহ নানাবিধ সমস্যা নিয়ে কাজ চলছে। এ কারণে নদে ৯৫টি ড্রেজারের মধ্যে ৫৫টি কাজ করতে পারছে, বাকিগুলো কাজ করতে পারছে না।এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফার অফিস টেলিফোনে রিং দিলে তার ব্যক্তিগত সহকারী মো. শাহজাহান জানান, ‘চেয়ারম্যান’ সাহেব মিটিংয়ে আছেন। পরে চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার রিং দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি