বাজারমূল্যের চেয়ে কমে কার্যাদেশ, ৩৪ কোটি টাকা তছরুপের পাঁয়তারা


বাজারমূল্যের চেয়ে কমে কার্যাদেশ, ৩৪ কোটি টাকা তছরুপের পাঁয়তারা
একটি প্রকল্পের অধীনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য একটি করে সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ক্যাথল্যাব, ডিজিটাল এক্স-রে, মেমোগ্রাফি, আল্ট্রাসাউন্ড, গ্যাস্ট্রোস্কপি, কোলনোস্কপি এবং প্যাক+ (পিকচার আর্কাইভ অ্যান্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম) ও আরআইএস কেনা হবে। এজন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে এবং একটি কোম্পানিকে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। যদিও কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি কারিগরিভাবে ‘রেসপনসিভ’ নয়। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিষ্ঠানটি বাজারমূল্যের চেয়ে কম দাম প্রস্তাব করে কার্যাদেশ পেয়েছে। জানা গেছে, গত এক বছরে যেখানে সব কিছুর দাম বেড়েছে, সেখানে স্বাস্থ্যের এই কেনাকাটায় সবকিছুর দাম অস্বাভাবিক হারে কমেছে। মাত্র দুই বছর আগে একই যন্ত্রপাতির দর ছিল প্রায় ৩৯ কোটি টাকা, দুই বছরের ব্যবধানে সেখানে কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান দর দিয়েছে ৩৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে কাজ পেতে নিম্নমানের আল্ট্রাসাউন্ড, সিটিস্ক্যান, এমআরআই যন্ত্রের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠনটিকে কাজ পাইয়ে দিতে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, হৃদরোগ হাসপাতালে কর্মরত একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং মন্ত্রণালয়ের ক্রয় ও সংগ্রহ শাখার একজন যুগ্ম সচিব সার্বিক সহযোগিতা করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, এর আগে এই প্রতিষ্ঠান দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে পিএসআই (প্রি শিপমেন্ট ইনসপেকশন) ছাড়াই মালপত্র সরবরাহ করে। এতে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করতে ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল সিএমএসডি (কেন্দ্রীয় ঔষধাগার) থেকে সুপারিশ করা হয়। পরে পিএসআইর অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার শর্তে ওই যাত্রায় রেহাই পায়। এখানেই শেষ নয়, প্রোগ্রামেবল অটোমেশন কন্ট্রোল সিস্টেম (প্যাক) যন্ত্র কেনাকাটা লটেও কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান নন-রেসপনসিভ হয়। তাই দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের লিখিত চিঠি দেয় স্পেসিফিকেশন (কারিগরি নির্দেশনা) ফের মূল্যায়ন করতে। এরপর চলতি বছরের গত ৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় সুপারিশকৃত প্রতিষ্ঠানের কারিগরি নির্দেশনা ফের মূল্যায়নে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে অবহিত করতে প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক বিষয়টি আমলে না নিয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর কারিগরিভাবে নন-রেসপনসিভ হওয়া প্রতিষ্ঠানকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। নিয়ম অনুযায়ী, কার্যাদেশ বা নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড ইস্যু করার পর একটি পত্র বা এনওএ বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটিকে (বিপিপিএ) পাঠাতে হয়। সে ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। বিষয়টি নিয়ে গত ১৭ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে সুপারিশকৃত প্রতিষ্ঠানের কারিগরি নির্দেশনা পুনর্মূল্যায়নে একটি অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পে যে এমআরআই কেনার প্রক্রিয়া চলছে, সেটি হিলিয়াম যুক্ত প্রযুক্তির। কিন্তু বর্তমান সময়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পরিবেশবান্ধব হিলিয়াম গ্যাস ছাড়া এমআরআই যন্ত্র রয়েছে। সেটি কেনা হলে ভবিষ্যতে হিলিয়ামের ঘাটতিজনিত কারণে এমআরআই যন্ত্র বন্ধ হয়ে সেবা ব্যাহত হবে না। কারিগরি নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়ার্কস্টেশন ও হার্ডওয়্যারগুলোর ব্র্যান্ড নাম উল্লেখ করার শর্ত থাকলেও কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান প্যাক সিস্টেম এবং ডাইকম মনিটরের কোনো ব্র্যান্ড ও মডেল অফার করেনি। অথচ দরপত্রে এটা উল্লেখ করা ছিল বাধ্যতামূলক। দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী প্যাক সিস্টেমের মধ্যে সর্বমোট ৩৭টি ডাইকম মনিটর চাওয়া হয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ২ কোটি টাকার বেশি। ডাইকম মনিটর ছাড়া ওই প্যাক সিস্টেম কোনোভাবেই কার্যকরী হবে না এবং সম্পূর্ণ প্যাকেজটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকবে, যার ফলে সরকারের ৩৪ কোটি টাকার অপচয় হবে। এই অভিযোগপত্রের অনুলিপি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ মহাপরিচালক; সিপিটিইউর মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন); যুগ্ম সচিব (ক্রয় ও সংগ্রহ), স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় এবং প্রকল্প পরিচালকে দেওয়া হয়েছে। তবে কেউই এ বিষয়টি আমলে নেননি। জানা গেছে, চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়ন, সময় ও ব্যয় সাশ্রয় এবং পরিবেশের ক্ষতিকর উপাদান হ্রাসের লক্ষ্যে আধুনিক হাসপাতালগুলোতে পিকচার আর্কাইভ অ্যান্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম-প্যাক ব্যবহৃত হয়। প্যাক সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রেডিওলজির চিত্র সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং রিপোর্ট প্রস্তুতে সুবিধা প্রদান করে। এতে প্রচলিত পদ্ধতিতে এক্স-রে, এমআরআই, সিটিস্ক্যানে ফিল্ম ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না, যা একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ও ব্যয় সাশ্রয়ী। অন্যদিকে, রেডিওলজি বিভাগে রোগ নির্ণয়ের নির্ভুলতা নিশ্চিতে বিশেষায়িত ডাইকম মনিটর ব্যবহার আবশ্যক। এই মনিটরগুলোতে উচ্চ রেজ্যুলিউশন, ক্যালিব্রেশন সুবিধা এবং মেডিকেল-গ্রেড লুমিন্যান্স থাকায় দাম সাধারণ মনিটরের তুলনায় ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি। বর্তমান বাজারে একটি উন্নতমানের ২ মেগাপিক্সেল ডাইকম মনিটরের সর্বনিম্ন মূল্য প্রায় ২ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। দরপত্রে ম্যামোগ্রাফির জন্য যে ডুয়েল-হেডেড ডাইকম মনিটর (ডুয়েল-হেডেড মেমোগ্রাফি ডাইকম মনিটর) চাওয়া হয়েছে, এর আন্তর্জাতিক বাজারদর সাধারণত ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলারের মধ্যে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে ৭টি প্যাকেজে এসব যন্ত্রপাতি কিনতে দরপত্র আহ্বান করেন প্রকল্পের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ। ওই সময় জাইকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি জাপানি যন্ত্রপাতি কেনাকাটার জন্য পিডিকে চাপ দিলে তিনি ওই দরপত্র বাতিল করেন। এক বছর পর প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের মাধ্যমে ২০২৩ সালে রাজস্ব অর্থায়নের ৫০ কোটি টাকার পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দরপত্রে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত কোনো সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এই দরপত্রে অংশ নেয়নি। অংশ না নেওয়ার কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, দরপত্রে প্রায় দুই দশক আগের পুরোনো মডেলের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার জন্য কারিগরি নির্দেশনা (স্পেসিফিকেশন) তৈরি করা হয়েছে। স্পেসিফিকেশনের ত্রুটিগুলো উল্লেখ করে সংশোধনের জন্য অনুরোধ করে সিমেন্স বাংলাদেশ, ফিলিপস বাংলাদেশ ও জিই বাংলাদেশ নামের কয়েকটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আরও কয়েকটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্যাকেজটি ভেঙে পৃথক পৃথক লটে ভাগ করে দরপত্র আহ্বানের অনুরোধ জানায়। এসব অনুরোধ আমলে না নিয়ে গত বছরের ১ আগস্ট ইরবিস ইন্টারন্যাশনালকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) প্রদান করেন। এই এনওএর বিপরীতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফুজি ফিল্ম হেলথ কেয়ার একটি উকিল নোটিশ পাঠায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ইরবিস ইন্টারন্যাশনাল কম্প্রিহেনসিভ মেইনটেন্যান্স কন্ট্রাক্ট অফার করেনি। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় চলতি বছরের গত ২৮ আগস্ট দরপত্রটি বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বান করতে নির্দেশ দেয়। এ সময় নতুন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ডা. মো. তরিকুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়ে তরিকুল ইসলাম আগের প্যাকেজটি তিনটি লটে ভাগ করে নতুন দরপত্র আহ্বান করেন। নতুন দরপত্রের আগে আন্তর্জাতিক যন্ত্র উৎপাদন ও সরবরাহকারী তিনটি প্রতিষ্ঠান পুরোনো হিলিয়াম পদ্ধতির এমআরআই যন্ত্রের পরিবর্তে আধুনিক এমআরআই যন্ত্র কিনতে অনুরোধ করে। এখানেই শেষ নয়, প্রোগ্রামেবল অটোমেশন কন্ট্রোল সিস্টেম (পিএসিএস) যন্ত্র কেনাকাটা লটেও ফুজি ফিল্ম হেলথ কেয়ার নন-রেসপনসিভ হয়। তারপরও প্রকল্প পরিচালক জাপানের ফুজি ফিল্মকে নিম্নমানের যন্ত্র কেনাকাটার কার্যাদেশ প্রদান করেন। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ফুজি ফিল্ম হেলথ কেয়ার পাবলিক প্রকিউরমেন্ট গাইডলাইন (পিজি) পাঠিয়ে লেখেন, জাপান সরকার বাংলাদেশ সরকারের স্যাংশনভুক্ত হলে ফুজি ফিল্ম হেলথ কেয়ার জাপান কোনো কাজ করতে বাধ্য থাকবে না। প্রকল্প পরিচালক বিষয়টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করলে পিজি গ্রহণ না করে দরপত্র বাতিলের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রকল্প পরিচালক এনওএ ইস্যু করেন। এদিকে প্রকল্প পরিচালক জাইকার অর্থে কেনাকাটার জন্য জিডি-১ ও জিডি-২ দরপত্র আহ্বান করেন। এতে পিপিআর-২০২৫-এর কোনো নিয়ম মানা হয়নি। দরপত্র আহ্বানের পর প্রকল্প পরিচালক প্রি-বিড সভায় নিম্নমানের কারিগরি নির্দেশনা (স্পেসিফিকেশন) তৈরি করেন প্রায় ৩৯ পৃষ্ঠার কারিগরি নির্দেশনা সংশোধন করে। নিয়মানুসারে এসব করার সুযোগ নেই। একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ দিতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, হিলিয়ামে ঝামেলা হয় বেশি, কথা সত্য। একবার হিলিয়াম নষ্ট হয়ে গেলে আবার ৬০ লাখ টাকা খরচের বিষয় চলে আসে। যন্ত্র বন্ধ থাকে তিন মাস। পৃথিবী এখন হিলিয়াম ফ্রি যন্ত্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। হিলিয়াম ফ্রি কিনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমাদের এই কেনাকাটায় হিলিয়াম এমআরআই কিনতে হচ্ছে। কারণ, এটা অনেক আগের পুরোনো কেনাকাটার প্রকল্প। হঠাৎ করে হিলিয়াম প্রযুক্তি বাদ দিলে সবগুলো সরবরাহকারী আবার দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। সেজন্য এখন আমরা দুটি অপশন খোলা রেখেছি। তিনি বলেন, ডায়াগনস্টিক ও রেডিওলজি ইমেজিং যন্ত্র কেনাকাটায় একটা অবজারভেশন ছিল। মন্ত্রণালয় আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে বলেছিল। আমরা কারিগরি কমিটির মাধ্যমে পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি।