বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা


অধিকার আদায়ে বাংলার মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো। মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তাদের লড়তে হয়েছে। সর্বশেষ আড়াইশ বছরের লড়াইয়ের কথা প্রায় সবারই জানা। লোকস্মৃতিতে ব্রিটিশ আমলের লড়াইয়ের কথা এখনও তাজা। তার পর পাকিস্তান আমল।বহু লড়াইয়ের পর শেষে অধিকার আদায়ে যুদ্ধেই নেমেছিল এ দেশের মানুষ। একাত্তরের সেই সময় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়েছিল নতুন দেশ– বাংলাদেশ। কিন্তু অধিকার রয়ে যায় অধরাই। শোষণ-বৈষম্য থেকে মুক্তি স্বপ্নই থেকে যায়। তাই যুদ্ধ জয়ের পরও লড়াই আর থামেনি।পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। আমরা নিরুপায় হয়ে সেই যুদ্ধে নেমেছি। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরেই প্রশিক্ষিত, উন্নত অস্ত্রধারী বাহিনীর বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়েছি। বিজয়ীও হয়েছি; কিন্তু মুক্তি মেলেনি। তাই স্বাধীনতা অর্জনের পরও ৫৩ বছর লড়তে হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য।কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, মানুষ কি সত্যিই এসবের জন্য লড়াই করেছে বা করে? ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছিল– সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার; সেসব কি সত্যিই মানুষ চেয়েছিল? কিংবা কোনো দলের মূলনীতিতে কি ছিল? মূলনীতি নির্ধারণের জন্য তো ভোট হয়নি, জরিপ হয়নি। আবার দেশ স্বাধীনের পর তিন মূলনীতিকে পাশ কাটিয়ে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ– এই চার মূলনীতির ভিত্তিতে সংবিধান তৈরি করা হয়। তাহলে কীভাবে বলা যাবে এসব জনগণের আকাঙ্ক্ষা?প্রশ্ন কঠিন। উত্তর দেওয়াও এখানে কঠিন। তবে বাংলা অঞ্চলের মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে জবাব মেলে। সে জন্য আমাদের জানতে হবে, আমরা কারা ছিলাম? কী কারণে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বারবার ধর্ম বদল করল? কারণ আমরা সম্মান হারিয়েছিলাম, অধিকার খুইয়েছিলাম। আমাদের ঘোষণা করা হয়েছিল শূদ্র, ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্য। সেই হৃত সম্মান, অধিকার পুনরুদ্ধারের লড়াইয়েই আমরা মত-পথ বদলেছি। পরে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়েছি; যে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছিল এ অঞ্চলের মানুষ, সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে নেমেছিল অধিকার আদায়ের জন্য। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত নেওয়া না হলেও অধিকার আদায়ের লড়াই বলে আস্থা পেলে মানুষ তাতে যুক্ত হয়েছে। বারবার অবশ্য প্রতারিতও হয়েছে। তবে আকাঙ্ক্ষা তার মরেনি। অনেকে যদিও হতাশ হয়ে সব ছেড়ে প্রান্তিক হয়ে রয়েছে। তবু সুযোগ হলেই বারবার জেগেছে।তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জনগণের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি। অর্থাৎ শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক উন্নতি।এভাবে যদি দেখি, তাহলে সাতচল্লিশ, একাত্তর, নব্বই ও চব্বিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক ও আকাঙ্ক্ষা সহজে চোখে পড়বে। চব্বিশেও মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছে। অসম সাহস নিয়ে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েছে। অথচ আন্দোলন খুব বড় কোনো দাবি নিয়ে ছিল না। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন তাকে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উন্নীত করেছে। আর তখনই অন্য শ্রেণি-পেশার জনগণ তার সঙ্গে সম্পর্কবোধ করেছে। শ্রমিক, মজুর, রিকশাওয়ালা, চাকরিজীবীরা যুক্ত হয়েছে। বিজয়ের পর আবার তাই উঠে এসেছে পুরোনো সেসব দাবিই– অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি।জাতির সুদীর্ঘ কালের অপূর্ণ এই আকাঙ্ক্ষা পূরণই সময়ের দাবি। আর দাবি পূরণে মাঠে নামা জাতিকে কখনও দমিয়ে রাখা যায়নি। উন্নত অস্ত্র, পরাশক্তির চোখ রাঙানি, শোষকের রক্তচক্ষু, সন্ত্রাস– কোনো কিছুই তাদের আটকাতে পারেনি।চব্বিশের বিজয়ের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে কথা হচ্ছে। নতুন অর্থনৈতিক বন্দোবস্তও যে জরুরি, তা নিয়ে কথা তেমন নেই। পুরোনো মাফিয়া, লুটেরা অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত বহাল রেখে নতুন রাজনীতি কি আদৌ সম্ভব বা টেকসই হবে?দেশের জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশই এখন তরুণ। এই তরুণদের নতুন অর্থনীতিতে যুক্ত করতে হবে। দেশকে উদ্যোক্তা জাতিতে পরিণত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি সে অনুযায়ী সাজাতে হবে, যেন এই তরুণরাই নতুন ও সফল শিল্প গড়তে পারে; পুরোনোদের মতো লুটপাট করে নয়, সত্যিকারের ব্যবসা/প্রতিষ্ঠান গড়ে। খাদ্য, প্রযুক্তি, অস্ত্র, পরিবহন, ড্রোন, বিমানসহ সব খাতে নতুন উদ্যোগ-সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।যুগে যুগে রাজনীতিকরা, রাষ্ট্র পরিচালকরা জনগণকে নানা স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছে। রাজনীতির দেখানো সেই স্বপ্নের জগৎ স্বর্গের মতো, সেখানে সবাই সমান, আছে নানা সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু বাস্তব সমাজে আমরা বৈষম্যপীড়িত, অসমান। এই বৈপরীত্য থেকে রাজনীতিকে সরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু কাজটা করবে কারা? নিশ্চয়ই সকল প্রজন্মের অংশগ্রহণে এর মূল দায়িত্ব নিতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই।