বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এনার্জিপ্যাকের প্রতারণা
অনলাইন নিউজ ডেক্স

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন পিএলসি বিনিয়োগকারীদের টাকা ব্যবহারে অনিয়ম করেছে। কোম্পানিটি ব্যাংক থেকে ১০-১২ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে সেই টাকা মাত্র ৫ শতাংশ সুদে সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে। এর আগের বছর এসব ঋণের বিপরীতে কোনো সুদই নেয়নি। এতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা লাভবান হচ্ছেন।২০২৪ হিসাব বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এনার্জিপ্যাকের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৯৭৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২৯২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এ ঋণের জন্য কোম্পানিকে ৬৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে। অন্যদিকে কোম্পানি তার ১৩টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে মোট ২৩৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। কিন্তু এ ঋণের বিপরীতে ছয় মাসে মাত্র ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা সুদ আয় হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ কম সুদে দেওয়া হলেও কোম্পানির মূল ঋণের বোঝা বাড়ছে।পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের টাকা দিয়ে শুধু অন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ঋণ দিতে পারে, তবে তা অবশ্যই বাজারমূল্য অনুযায়ী হতে হবে। কিন্তু এনার্জিপ্যাক তালিকাভুক্ত নয়—এমন প্রতিষ্ঠানেও কম সুদে ঋণ দিয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি।এনার্জিপ্যাকের দেওয়া ঋণ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে সোনারগাঁও লেদার অ্যান্ড রেক্সিন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (১৫৫.২৫ কোটি টাকা), এনার্জিপ্যাক পাওয়ার ভেঞ্চার লিমিটেড (৪৬.৪৩ কোটি টাকা), ইপিভি চট্টগ্রাম লিমিটেড (১১.৫৪ কোটি টাকা), এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড (৫.৯৪ কোটি টাকা), এনার্জিপ্যাক এগ্রো লিমিটেড (৯৮.৫৪ লাখ টাকা)-সহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পেয়েছে, যেখানে কোম্পানি নিজে ব্যাংক থেকে ১০-১২ শতাংশ সুদে ঋণ নিচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ দিয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়া পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থের সঙ্গে যায়, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি।২০২৪ সালের জুন-ডিসেম্বর সময়ে এনার্জিপ্যাক ১৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা লোকসান করেছে। প্রধান কারণ ছিল ৬৪ কোটি ১৫ লাখ টাকার সুদ ব্যয়। ফলে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯৮ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৯ পয়সা। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ১৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে এনার্জিপ্যাক। আগের বছরে একই সময়ে মুনাফা ছিল মাত্র ৬৮ লাখ টাকা।মুনাফা করলেও কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ২০২৪ হিসাব বছরে কোনো লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দেয়নি, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশার কারণ। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এ অনিয়ম বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদে কষ্ট করে ব্যবসা চালিয়ে কম সুদে নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ দেওয়া আর্থিক স্বচ্ছতার পরিপন্থি।এনার্জিপ্যাকের চেয়ারম্যান রবিউল আলম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ ও সিএফও আমিনুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কোনো ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি। কোম্পানির সচিব আলাউদ্দিন শিবলী ফোন রিসিভ করেননি এবং খুদে বার্তারও উত্তর দেননি। ফলে বিনিয়োগকারীদের কাছে কোনো ব্যাখ্যা আসেনি।এনার্জিপ্যাকের বর্তমান শেয়ারবাজার অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কোম্পানিটি ‘বি’ ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত এবং এর অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা, পরিশোধিত মূলধন ১৯০.১৬ কোটি টাকা। কোম্পানির রিজার্ভে রয়েছে ৩২৯.৬৪ কোটি টাকা। মোট শেয়ার সংখ্যা ১৯ কোটি ১ লাখ ৬৩ হাজার ২১৬টি। উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৫৪.১৩ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ১৭.১৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ২৮.৭০ শতাংশ শেয়ার।৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৫.১৮ টাকা, আর শেয়ারপ্রতি নেট সম্পদমূল্য (NAV) দাঁড়িয়েছে ৩৭.৪৫ টাকা। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কোম্পানির এমন অনিয়ম নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত নজরে আসা প্রয়োজন, যাতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
