বিলুপ্তির পথে বউলা


অতীতে কাগজপত্র লাগানোর জন্য আজকের মতো আইকা বা সুপার গ্লুর মতো কোনো আঠা ছিল না। সেকালে আঠা সংগ্রহ করা হতো বিভিন্ন গাছ বা গাছের ফল থেকে। এগুলোর মধ্যে সুলভ ছিল জিওলগাছের আঠা বা গদ। এ গাছকে কিতাবি ভাষায় বলে জিকা বা জিগাগাছ। কাণ্ডে ক্ষত করে দিলে সেখান থেকে ঘন জেলির মতো আঠা জমা হতো। ছোটবেলায় আর একটি গাছকে দেখেছি, যার নরম পাকা ফল টিপলে খোসা ফেটে বেরিয়ে আসত গাম টিউবের মতো তরল আঠা। দুই আঙুলে মাখলে চটচটে আঠায় আটকে ধরত আঙুল। এসব আঠা দিয়েই আমরা ছোটবেলায় রঙিন কাগজ বা পুরোনো খবরের কাগজ কেটে ঘুড়ি বানাতাম, ঘরের বেড়ায় ছবি কেটে লাগাতাম, বই ছিঁড়ে গেলে জোড়া দিতাম। এসব এখন অতীত স্মৃতি। এসব আঠা-উৎপাদী গাছপালা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে গিয়েছিলাম একদিন মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। সেখানে জলাশয়ের ধারে একটি ছোট্ট হিজল-তমালবীথি আছে। সেসব গাছের নীল ছায়ায় বসে থাকলে হিজল-তমালের অনেক সাহিত্য মনে আসে। এ গাছ দুটি বর্তমানে বাংলায় বাস্তবের চেয়ে বেশি বেঁচে আছে বাংলা কবিতায়। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে সেই হিজল-তমালবীথির পাশে একটা ছাউনির নিচে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি, সামনের ঝিল থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে চোখে-মুখে ঝাপটা দিচ্ছে। কিন্তু সে বাতাসের পরশের চেয়ে বেশি শান্তি পেলাম সে ছাউনির সামনে থাকা বিলুপ্তপ্রায় একটা গাছ দেখে। ছোটবেলায় দেখা সেই গাছ! প্রায় ৫০ বছর পর আবার দেখা পেলাম! অবশ্য এর মধ্যে ২০১৮ সালে পাকা ফলে ভরা এর একটি গাছের দেখা পেয়েছিলাম চেন্নাইয়ে, কুমিরের পার্কে। তাই গাছটিকে দেখে আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে কাছে গিয়ে দেখলাম, ছোট হলেও গাছ ভরে সবুজ কাঁচা ফল ধরে আছে। ছোটবেলায় এ গাছকে আমরা বলতাম বলাগাছ, পাকা ফলের রসকে বলতাম বলার আঠা। যশোর-খুলনা এলাকায় এ নামটাই প্রচলিত ছিল। বলা নামে বইপত্রে এ গাছটার কোনো নাম নেই। তবে বউলা নামটা আছে। এই বউলাই হয়তো লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে বলা। এ নাম ছাড়া এ গাছের আরও এক ডজন বাংলা নাম আছে। এগুলো হলো বহনারি, বোহারি, বহুল, বোয়ারা, লাশকারা, লাগোরা, আসলিয়া, বনারি, বাহুবারা, বাহুদুরি ইত্যাদি। সিলেট অঞ্চলে এ গাছ কালাহুজা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বুহাল বলে। ইংরেজি নাম সোপ বেরি, গ্লু বেরি বা ইন্ডিয়ান চেরি। এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Cordia dichotoma ও গোত্র বোরাঞ্জিনেসি। এই শ্রাবণে আর একবার যাওয়ার সুযোগ হলো জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। আশা ছিল বউলার পাকা ফল দেখব, তার স্বাদ পরখ করব। প্রকৃতিদেবী আমার সে বাসনা অপূর্ণ রাখেননি। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের প্রবেশমূল্য শত টাকাও আমার সে ইচ্ছায় বাদ সাধেনি। শ্রাবণের এক সকালে ঢুকে প্রথমেই গেলাম সে গাছটির কাছে। ফলগুলো দেখে মনে হলো অনেক আগেই ফলগুলো পাকতে শুরু করেছে। তারপরও গাছে তখনো অনেক পাকা পাকা ফল ঝুলছে। হালকা সবুজ রঙের কাঁচা ফলগুলো এখন পেকে গোলাপি হয়ে গেছে। আঙুরের মতো ছোট ফলগুলোকে দেখেই খেতে লোভ লাগে। সে লোভ সংবরণ করতে না পেরে কিছু না জেনেবুঝেই একটা পাকা রসালো ফল দুই আঙুলে টিপ দিয়ে খোসা রেখে মুখে চালান করে দিলাম। স্বাদটা মন্দ না, পানসে মিঠা। কিন্তু আঠা? আঠা যেখানে যেখানে লাগছে, সেখানেই তো আটকে ধরছে। দুই ঠোঁট যেন জোড়া লাগতে চাইছে সে আঠায়। তাড়াতাড়ি জল দিয়ে মুখ ভালো করে ধুয়ে সেই আঠা থেকে অবশেষে নিষ্কৃতি পেলাম। বউলা আমাদের দেশি বা চিনা গাছ, জন্ম ইন্দোমালয় অঞ্চলে। গাছটি পত্রঝরা স্বভাবের ছোট থেকে মাঝারি আকারের বৃক্ষ। গাছের উচ্চতা ৩ থেকে ৪ মিটার। গোড়ার কাণ্ড কিছুটা ওঠার পর প্রচুর ডালপালা ছড়িয়ে গাছটা ঝোপালো হয়ে যায়। পাতা সরল, কিনারা হালকা খাঁজকাটা, উপবৃত্তাকার। কিছু প্রজাপতির বাচ্চা এর পাতা খেয়ে বাঁচে। অনেকগুলো ক্ষুদ্র সাদা রঙের ফুল ফোটে মঞ্জরিতে, ফুল ফোটে রাতের বেলায়, ফুলের বোঁটা খাটো। ফুল উভলিঙ্গী, স্বপরাগায়নের মাধ্যমে ফল গঠিত হয়। কাঁচা ফল টক বলে কোনো কোনো দেশে আদার সঙ্গে কাঁচা ফল দিয়ে আচার বানানো হয়। গাছের পাতা গবাদিপশুকে খাওয়ানো হয়। গাছটির অনেক ঔষধি গুণও আছে। ঠান্ডা লাগা, সর্দি–কাশি, গলাব্যথা, নাক বন্ধ, শ্বাসজনিত সমস্যা ইত্যাদি নিরাময়ের জন্য এ গাছের বিভিন্ন অংশ আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। গাছটি সংরক্ষণ করা দরকার। মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক