বৈশ্বিকভাবে নেতিবাচক পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত


বৈশ্বিকভাবে নেতিবাচক পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত
খেলাপি ঋণের বেপরোয়া ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বৈশ্বিকভাবে নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিকে ভালো চোখে দেখছে না। বৈশ্বিক ঋণ মান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলো মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি বাড়ার কারণে দেশের ব্যাংক খাতের রেটিং কমিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যাংক খাতের সার্বিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বড় বড় ব্যাংকগুলো ব্যবসায়িক লেনদেন বা বৈদেশিক ঋণের গ্যারান্টি দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে। ওইসব ব্যাংক লেনদেন বা গ্যারান্টি দেওয়ার আগে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করছে। সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট করা হয়েছে। বিদেশে পাচার করা হয়েছে লুটের টাকার একটি বড় অংশ। ওইসব ঋণ এখন আর আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খেলাপি হিসাবে শ্রেণিকরণ করছে। আগে ঋণের টাকা খেলাপিযোগ্য হলেও তা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি। লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খেলাপি ঋণ বাস্তবতার তুলনায় কম বেড়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খেলাপি ঋণ পাগলা ঘোড়ার গতিতে বাড়তে থাকে। ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল লাখ কোটি টাকার নিচে অর্থাৎ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে প্রথম খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার আগের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা ছিল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে লুটপাটের চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে ৬ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে সাধারণত কোনো ব্যাংকের ৩ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণকে ঝুঁকিমুক্ত ধরা হয়। এর বেশি থাকলেই ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে শনাক্ত করে। এ হিসাবেও স্থানীয় সব ব্যাংকই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ স্থানীয় সব ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের ওপরে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য দেশের ব্যাংকগুলো সম্পন্ন করে বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে বাণিজ্যিক ঋণের বড় অংশই লেনদেন হয় বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যস্থতায়। বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে দেখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি-এই তিনটি সূচকই সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় নেয়। এই তিন খাতেই দেশের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। পণ্য আমদানি করতে বিদেশি ব্যাংককে নির্ধারিত সময়ে অর্থ পরিশোধের নিশ্চয়তা দিতে হচ্ছে। প্রয়োজনে কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি গ্যারান্টি লাগছে। এসবই দিতে হচ্ছে গ্রাহককে। এতে আমদানি পণ্যের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে পণ্যের দামও। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসা খরচও, যা ভোক্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে বৈশ্বিক ঋণ মান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলোও বাংলাদেশকে সতর্ক করছে। কারণ খেলাপি ঋণ বেশি বাড়লে তারা বাংলাদেশের ঋণ মানের রেটিং নামিয়ে দেবে। এসব সংস্থার রেটিং বৈশ্বিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদের রেটিংয়ের ভিত্তিতে বিদেশি ব্যাংকগুলো বৈদেশিক লেনদেনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। রেটিং খারাপ হলে লেনদেনে নিরুৎসাহিত হয় বা বাড়তি গ্যারান্টি নেয়। ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। এতে একদিকে দেশের আর্থিক খাতের ইমেজ নষ্ট হয়। অন্যদিকে খরচ বাড়ার কারণে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যায়। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা খেলাপি ঋণ কমাতে জোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফ বাংলাদেশের ঋণ চুক্তির সময় সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। খেলাপি ঋণ তো কমানো যাচ্ছেই না, উল্টো বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে গত রোববার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডিদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমাতে। কারণ বৈশ্বিক সংস্থাগুলো খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে নেতিবাচক মন্তব্য করছে। এতে বৈশ্বিকভাবে ঋণ মানও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।