মিল্টন সমাদ্দারের যত ‘অপকর্ম’


প্রতিবন্ধী, ভবঘুরে, বাকপ্রতিবন্ধী, অন্ধ ও অসুস্থ বৃদ্ধদের খোঁজ পেলেই তাদের আশ্রমে আনতে ছুটে যান মিল্টন সমাদ্দার ও তার দলের লোকেরা। এসব মানবিক কর্যকলাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরে সমাজের ধনাঢ্য মানুষের কাছে অর্থ সহায়তা চান তিনি। মিল্টনের ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে সহায়তা হিসাবে জমা পড়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এসব টাকায় রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ায় গড়ে তুলেছেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার। বর্তমানে সেখানে ২০ জনের মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আশ্রিত রয়েছেন। এছাড়া সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর বাহিটটেক এলাকায় কিনেছেন ৫৫ শতাংশ জমি। এর মধ্যে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। মিল্টনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ ভবনে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ পুরুষের সংখ্যা ২৪৫ জন। সরেজমিন সাভারের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে গিয়ে দেখা যায়, এখানে ৫০-৬০ জনের মতো আশ্রিত রয়েছেন। এছাড়া, দুটি শাখায় ৬০ থেকে ৭০ জন কর্মচারী রয়েছেন। আর এ আশ্রমের ম্যানেজারের দায়িত্বে রয়েছেন দেবাশীষ হালদার ও সুপারভাইজার আলমগীর হোসেন। মিল্টন গ্রেফতারের পরও চলছে আশ্রমের কার্যক্রম। অথচ বিভিন্ন সময় মিল্টন ফেসবুক লাইভে দাবি করেন দুটি শাখায় ৮ থেকে ৯শ মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, মিল্টনের সাভারের আশ্রমের পাশের জমির মালিক শামসুদ্দিন চৌধুরী। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটির অভিযোগ- বহুদিন ধরে এ জমির দিকে মিল্টনের নজর রয়েছে। ঈদুল ফিতরের আগের দিন পরিবারসহ জমি দেখতে গেলে মিল্টনের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে মিল্টন আশ্রমের মধ্যে পরিবারের সবাইকে আটকে নির্যাতন করে। স্থানীয়রা জানান, আশ্রম পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা মিল্টন সমাদ্দারের ভয়ে তটস্থ। অনেকেই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। কারণ আশ্রমের কর্মচারীরা মিল্টনের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে কাজ করে। তাদের মাধ্যমে মিল্টন জমি দখল, স্থানীয়দের ভয়ভীতি ও নির্যাতন করে আসছে। মিল্টন সমাদ্দার ও তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ার বাসিন্দাদের স্পর্শকাতর একটি অভিযোগ রয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, আশ্রমে দুই থেকে তিন দিন পরই মানুষ মারা যেত। পরে গোসলের জন্য তাদের পাশের বায়তুস সালাহ মসজিদে নিয়ে যাওয়া হতো। মসজিদে গোসলের কাজে নিয়োজিতরা লাশে সন্দেহজনক কাটাছেঁড়া দেখতে পান। এতে শরীর থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চুরির সন্দেহ করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। দুই মাসে ১৮ কবর: সাভারের আশ্রমসংলগ্ন পশ্চিম পাশে আনুমানিক চার থেকে পাঁচ শতাংশ জমি সীমানা প্রাচীর করে কবরস্থানের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ আশ্রম উদ্বোধন করা হয়েছে ১ মার্চ। অর্থাৎ দুই মাসে এ কবরস্থানে ১৮টি লাশ দাফন করা হয়েছে। স্থানীয় রফিকুল ইসলাম বলেন, মাস দুয়েক আগে রাত ১১টার দিকে আশ্রমের এক লোক আমাকে একটি কবর খুঁড়তে বলেন। এরপর প্রায়ই আমাকে দিয়ে তারা করব খুঁড়ে লাশ দাফন করতেন। এর মধ্যে হঠাৎ এক রাতে চারটি লাশ নিয়ে আসে। তখন আমার সন্দেহ হয়। মনে মনে প্রশ্ন করি, এত লাশ কোথা থেকে আসে। অথচ এ আশ্রমে আশ্রিত ৫০-৬০ জন। এরপর থেকে আমি তাদের কবর খোঁড়ার বিষয়ে নিষেধ করে দেই। রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, আশ্রমের ছয়তলা ভবনের নিচতলার উত্তর পাশে একটি আলাদা কক্ষ (টর্চার সেল) তৈরি করা হয়েছে। এ রুমে আটকে রেখে কাউকে সারা দিন পেটালেও চিৎকারের আওয়াজ বাইরে আসবে না। মাঝেমধ্যে চিৎকারের আওয়াজ পেতাম। তবে বুঝে উঠতে পারতাম না কান্নার আওয়াজ কোন দিক থেকে আসে। একই গ্রামের বাসিন্দা ঈমান আলী বলেন, এ কবরস্থানের যেকটি লাশ দাফন করা হয়েছে প্রত্যেকটিই কাটাছেঁড়া থাকত। এ কারণে গোসলের কাজে নিয়োজিত একজন গোসল করাতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আশ্রমের পক্ষ থেকে সেখানে লাশ পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। মৃত্যুসনদ জাল করার অভিযোগে মামলা : মৃত্যুসনদ জাল করার অভিযোগে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মিরপুর বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ কামাল পাশা বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার মিরপুর থানায় মামলাটি করেন। এছাড়া মানব পাচার ও অবৈধভাবে আটকে রাখার অভিযোগে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ ও এজাহার সূত্রে জানা যায়, মিল্টন সমাদ্দার তার আশ্রমে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মৃত্যুসনদ জাল করতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি চিকিৎসকের স্বাক্ষর ও সিল জাল করতেন। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতির মামলা হয়েছে। এ ছাড়া মানব পাচার ও অবৈধভাবে আটক রাখার অভিযোগে আরও দুটি মামলা প্রক্রিয়াধীন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, মিল্টন সমাদ্দার কোনো নিবন্ধিত চিকিৎসক নন। পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠানে কোনো নিবন্ধিত চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তিনি চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার সেবার নামে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ উপার্জন করেন। তিনি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যুসনদ বানাতেন। মিল্টন সমাদ্দার নিজেই মৃত সনদে চিকিৎসক সেজে স্বাক্ষর করতেন। মিল্টন সমাদ্দার ও তার ব্যবস্থাপক কিশোর বালা মানবতার সেবার নামে অজ্ঞাতনামা শিশুসহ বয়স্ক লোকদের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। সাভারের আশ্রমে যা রয়েছে : স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মিল্টন সমাদ্দার এখানে প্রায় ৫৫ শতাংশ জমি কিনে একটি ছয় তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। ভবনের ঠিক পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি কবরস্থান। পূর্বপাশ ঘেঁষে একটি টিনশেড নির্মাণ করা হয়। এ শেডের অর্ধেক জায়গায় গাড়ি রাখার স্থান। শেডে একটি হলুদ রংয়ের নতুন পিকআপ ভ্যান ও একটি নতুন সাদা রংয়ের মাইক্রোবাস রয়েছে। আর অর্ধেক জায়গায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। ভবনের দক্ষিণ পাশে কর্মচারীদের থাকার ঘর। বাকি জায়গা পতিত পড়ে আছে।