মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের প্রতি কোনোই সহমর্মিতা নেই?


রাজাকার, আলবদর আর ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা মন্ত্রী হয়েছেন। ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতায় তাদের চরম বিরোধিতা ও বৈরিতার মুখে স্বাধীনতা পাওয়া এ দেশে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন তারাই। যে লোকরা ভিনদেশি পাকিস্তানিদের পথ চিনিয়ে কোন বাড়িতে মুক্তি আছে, কোন বাড়ির মেয়েরা বালেগ হয়েছে কিংবা নাবালিকা হলেও সুন্দর, তাদের বাড়ি চিনিয়েছে ভিন্ন দেশিদের, পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের যৌনসুখের জোগান দিতে এমন কিছু নেই করেননি, সেই রাজাকার-আলবদররা মন্ত্রী হয়ে তাদের গাড়িতে পতপত করে উড়িয়েছে রক্তের বন্যায় পাওয়া স্বাধীনতা। তখন আজকের মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধীরা কোথায় ছিলেন? ধরেই নিলাম তারা বয়সে হয়তো নালায়েক ছিলেন, কিন্তু রাজাকারের গাড়িতে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়তে দেখে তাদের বাবা-চাচা বা দাদাদের শরীরের পশমে কি টান পড়েছিল? হৃদযন্ত্রে খানিক ধাক্কা লেগেছিল? না এসবের কিছুই হয়নি! যদি হতো, তবে নালায়েক-নাবালক সেদিনের তরুণ-যুবাদের স্মৃতিতে কিছু হলেও থাকত। চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর আর তাদের উত্তরসূরিরা যখন নানা পদ-পদবি, মন্ত্রিত্বের মর্যাদা পান, গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে ঘোরেন, নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, তখন আজকের মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা কোথায় থাকেন? যখনই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য নামমাত্র কোটা বরাদ্দ হয়, তখন আপনারা যারা ফাল দিয়ে উঠেন, তাদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পরিচয় জানতে বড্ড ইচ্ছা হয়-আপনারা কারা, কাদের উত্তরসূরি? সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা ও তথ্য সংগ্রহকারী বাহিনীর প্রতিনিধিকে তাদের পরিচয় শনাক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি। আপনারা কি এমন ঘটনা জানেন, যে মুক্তিযোদ্ধার এক সন্তান লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন, উপরন্তু রেকর্ড পরিমাণ নম্বরও পান? কোটার নীতিমতো সেই সন্তানটিকে শুধু ভাইভাতে গিয়ে সেই কোটার প্রয়োগ বা সুযোগ দেওয়া হয়। তবে বাস্তবতা হলো, লিখিত পরীক্ষার রেকর্ড নম্বর পেয়েও শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটার আবেদন করেছেন বলে সেই শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীকে ভাইভা বোর্ডে অপেক্ষমাণ রুমে বসিয়ে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা! সেই পরীক্ষার্থীর আকুতির মুখে ভাইভা বোর্ডে বিচারকদের সামনে নেওয়া হলেও সেই শিক্ষার্থীকে কোনো প্রশ্নই জিজ্ঞেস করা হয়নি বরং বলা হয়েছে, তোমার ভাইভার কী দরকার, মুক্তিযোদ্ধার সনদ ধুয়ে খাওগে, এসব বাস্তবতা এবং এমন অদ্ভুত সত্য ঘটনা এ দেশেই ঘটেছে! কষ্ট হয়, বড় কষ্ট, এ দেশের চোর-দুর্নীতিবাজরা চুরি করে পার পায়। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিলেও কোনো সম্মানহানি হয় না। অথচ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করা শিক্ষার্থীকে ভাইভা বোর্ডে শিক্ষকরা তাদের সন্তানের বয়সি স্বপ্নবাজ পরীক্ষার্থীকে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় আবেদন করায় লজ্জা দেন, অপদস্ত করেন! একবারও তারা ভাবেন না, এ শিক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষার কতবড় ঝক্কি, লম্বা পথ পেরিয়ে তবেই ভাইভা বোর্ডে এসেছেন। বাস্তবে দেখেছি, ‘বাপে মানে না মায়ে গছে না’ এমন লোকও মামা শ্বশুরের জোরে লবিং করে এনজিওর অনুমোদন নেন। জোর তদবিরে লবিংয়ের জোরে পত্রিকার লাইসেন্স পান! দেশ-বিদেশ ঘোরেন, ভিন্ন দেশে মরুর বুকে কবিতা গাইতে যাওয়ার তদবির করেন, তখন তাদের লজ্জা লাগে না! কিন্তু যখনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে রাষ্ট্রীয় খরচে হজে নেওয়া হয়, তখন সেই তারাই লজ্জা পান! অদ্ভুত না? রাষ্ট্রের সুবিধাভোগীরা এক মুক্তিযোদ্ধাকে হজে নেওয়ায় পারলে মুক্তিযোদ্ধার মূল্যবোধের পোস্টমর্টেম করেন! অথচ ওই জ্ঞানী-গুণিজন আপনারা যে সারা দিন লবিং আর তেলবাজি করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কত কিছু ছলেবলে কৌশলে আদায় করেন, তখন সেসবের হিসাব মুক্তিযোদ্ধারা রাখে না, আজকের আন্দোলনকারীরাও। আরও কী জানেন, আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান বাবা, চাচা ও স্বজনদের বাস্তবে কাছ থেকে দেখেছি, তারা বিত্তশালী ও ভোগবাদী নন। আজ মুক্তিযোদ্ধা নামে অর্থ ও বিত্তশালী যাদের দেখছেন, তাদের সবাই সমাজের সুবিধাভোগী। তাদের বেশিরভাগ যুদ্ধের ময়দান পালালেও স্বাধীনতার পর সুবিধা আদায়ে এগিয়ে ছিলেন। আমার বাবার সঙ্গে তার বিত্তবান যে বন্ধুরা আবেগের বশে সহযাত্রী হয়ে যুদ্ধ করার মনোবৃত্তি নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন, তারা সমবয়সি ও একই এলাকার ১৫ থেকে ২৫ জন। শেষ পর্যন্ত সেই বন্ধু গ্রুপের মাত্র ৭-৯ জন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে যুদ্ধ করেছেন। বাকিরা কদিন এদিক-সেদিক ঘুরে, হোটেলে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে যুদ্ধদিন গুজরান করেছেন। তাদের কেউ কেউ প্রশিক্ষণ শেষ না করেই পালিয়ে গেছেন। কারণ, যুদ্ধের ময়দানের অনিশ্চয়তা, কঠোর-কঠিন পরিশ্রম, দিনের পর দিন ভালো-মন্দ দূরের কথা, না খাওয়া পরিস্থিতি তারা মানাতে পারেননি। যুদ্ধের ময়দানেও তারা ঘরের সেই আরাম-আয়েশের জীবনের মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। যুদ্ধ করার জন্য যে সাহস ও কঠিন আত্মত্যাগী মনোভাবের প্রয়োজন হয়, বেশিরভাগের সেই সাহস ও মনোবৃত্তি ছিল না। ফলে ১৯৭১র ভয়াবহ যুদ্ধদিনে প্রশিক্ষণের নামে পালিয়ে ভিন্ন দেশে কোনোমতে ঘাপটি মেরে সময় পার করেছেন। ১৯৭১র ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র তারা দেশে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে সেই আগের সুযোগ-আরাম-আয়েশের জীবনে ফিরেছেন। লেখাপড়া শুরু করেছেন, চাকরি, উচ্চশিক্ষা সবই শুরু করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন নতুন রুটিনে। আর সত্যিকারের অকুতোভয় বীররা যুদ্ধদিনের ভয়াবহতাকে জয় করে কী করেছেন জানেন? উচ্চশিক্ষায় রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপে পাড়ি দেননি। বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশকে গড়ে তুলতে নিজেকে আরেক দফায় নিয়োজিত করেছেন। উচ্চশিক্ষার হাতছানি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সব অচল প্রায় ভাঙাচোরা, ক্ষতবিক্ষত রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো যেন আবারও সচল হয়, তাই ছোট-বড় পদ-পদবি ভাবেননি, যে যে পদে পেরেছেন, যোগদান করে দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন দিনের সূচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। তবে যুদ্ধদিনে ময়দান পালানো বীররা ঠিকই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বসবাসযোগ্য স্বাধীন দেশের সুসময়ে ফিরেছেন। দেশে ফিরে নতুন নতুন পদবিতে পা ভারি আর পশ্চাৎদেশ উঁচিয়ে উপভোগ করেছেন চাকরির পদ-পদবির ভারিক্কি ওজন! ইতিহাস পড়ুন, যেসব দেশ রক্ত দিয়ে স্বাধীন হয়েছে, সেই সব দেশে বীরদের ‘হিরো’ গণ্য করে কীভাবে মর্যাদার পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। দেখুন, জানুন, খোঁজ নিন। পারলে পরিবারের মুক্তিযোদ্ধা বাবা, চাচা ও কাছের স্বজনদের কেউ থাকলে তাদের মুখে শুনুন যুদ্ধদিনের ভয়াবহ সব গল্পগাথার বাস্তব কঠিন ও দুঃসহ সব ঐতিহাসিক সত্য। তবেই এ বীর মুক্তিযোদ্ধা-হিরোদের কদর বুঝতে পারবেন আপনারা। তবে আজকে যারা আমার-আপনার চারপাশে নানা সুযোগ-সুবিধায়বেষ্টিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, যারা ভীরু, কাপুরুষ, যারা আমার-আপনার বাবা-চাচাদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে ঘর ছেড়েছিলেন বটে; কিন্তু যুদ্ধের ময়দান যে ভোগ-আরাম-আয়েশের জায়গা না বুঝে কঠিন দুঃসহ সময়ে সেই যুদ্ধদিনে শামিল হতে গিয়েও ভোগের জীবনে ফিরে এসেছিলেন, তাদের দেখে প্রকৃত বীরদের মূল্যায়ন করবেন না প্লিজ। যদিও সেই ভীরুরাই, যুদ্ধদিনে ময়দান পালানো সেই চেনা মুখগুলোই আজ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের প্রথম সারিতে। কারণ, যুদ্ধশেষে স্বাধীন দেশে তারাই সময়মতো লেখাপড়া শেষ করে খেয়েপরে আরামে-আয়েশে উন্নত জীবন গড়েছেন। তাতে খুব দোষের কিছু না, তবে ময়দানপালানো সেই ভীরুরাই যখন মুক্তিযোদ্ধার বেশে প্রকৃত যোদ্ধাদের বীরত্বকে খাটো করে পুরো রাষ্ট্রে, সমাজে, সর্বোপরি নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযোদ্ধা নামের মাহাত্ম্যে কালিমা লেপে মুক্তিযোদ্ধার নামে অভক্তির সৃষ্টি করে, তাদের বিচারে কাঠগড়ায় তুলবে কে? আপনারা নতুন প্রজন্ম, আপনারা তা না করে পুরো একঝুড়ি আমের মধ্যে পচা এক দুটি আমের কারণে পুরো ঝুড়িকে পরিত্যক্ত করছেন? তাই আপনাদের মতো নতুন প্রজন্ম, যারা নিজেদের অস্তিত্বের খোঁজ জানেন না, স্বাধীনতার মানে বোঝেন না, আপনাদের নিজের মেধা ও মননের জোর কম হবে এটাই স্বাভাবিক! নিজ দেশে স্বাধীনতার সুখ কী যারা বোঝে না, তারাই বীরদের হেলা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্য কোটা নিয়ে যুদ্ধে নামে। বাবা, চাচা বা আর কোনো স্বজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধে গিয়ে থাকলে তাদের কাছে যুদ্ধদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা জানুন। তাদের মুখে কিছু গল্প শোনার সৌভাগ্য হলে আপনাদের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন অ্যালার্জি থাকবে না আশা করি। তবে এটি শতভাগ ঠিক, যুদ্ধদিনের ভয়াবহ ঘটনায় আর যে অদম্য সাহসে যে মানুষগুলো ১৯৭১-এ অস্ত্র ধরেছিলেন, তারা দেশ স্বাধীন হবে, স্বাধীন বাংলাদেশ পাবেন, এর বাইরে আর কিছুই আশা-প্রত্যাশা করেননি, কোটা-ফোটা তো বহু দূরের কথা। ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে কোনো প্রলোভনই তাদের সামনে ছিল না। শুধুই ছিল স্বাধীন দেশে নিজের মতো বাঁচার প্রবল আশা ও ভরসা। কী দুর্ভাগ্য আমাদের এদেশের তরুণ সমাজের! উচ্চবিত্তের উচ্চপদধারীরা উত্তরা, গুলশান, বনানী, রিমঝিম, পূর্বাচল বা পশ্চিমাঞ্চলে নামে-বেনামে প্লট, ফ্ল্যাট আর কোটি টাকার শুল্কমুক্ত গাড়ি পেতে পারেন, তাতে দোষ নেই। তখন প্রতিবাদ করার কেউ থাকে না, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করলেই গা জ্বলে যাদের, আপনারা কারা? তাদের চিহ্নিত করার আবেদন করছি। জান্নাতুল বাকেয়া কেকা : বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই Bakiyakeka@gmail.com