মুন্সীগঞ্জে এক আড়ৎতে প্রতিদিন বিক্রি হয় কয়েক কোটি টাকা তরমুজ।


মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার ধলেশ্বরী নদীঘেঁষে মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাট এলাকার আড়ৎতে প্রতিদিন বিক্রি হয় কয়েক কোটি টাকার তরমুজ ও বাঙ্গি। এই আড়ৎতের পাশেই ধরেশ^রী নদীতে প্রতিদিন দেশের দক্ষিণাঞ্চল হতে ট্রলারে ভরে এ সমস্ত তরমুজ আসে আড়ৎতে। সারিবদ্ধভাবে নদীতে রাখা ট্রলারগুলো হতে চাঙ্গারী (ঝুপড়ি) ভরে এ তরমুজ উঠানো হয় আড়ৎগুলোর সামনে। সকাল ৬ টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে এসব আড়ৎতে বেচাঁকেনা । প্রতিদিন এ আড়ৎতে বিক্রি হয় কয়েক কোটি টাকার তরমুজ।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,ওই আড়ৎতের পাশে ধরেশ^রী নদীতে রাখা আছে বেশ কিছু তরমুজ ও বাঙ্গি ভর্তি ট্রলার। এ সমস্ত একেকটি ট্রলারে ১০ থেকে ১৫ হাজার তরমুজ রয়েছে। ট্রলার হতে চাঙ্গারী ( ঝুপড়ি) বোঝাই করে তরমুজ বাঙ্গিগুলো তোলা হচ্ছে আড়ৎতের সামনে উন্মুক্ত আকাশের নিচে। ওইখানে তরমুজগুলোকে বাছাই করে রাখা হচ্ছে বিভিন্ন সাইজ অনুসারে। এসব তরমুজ ও বাঙ্গির স্তুুপ করে পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা। পুরো হাট ভর্তি ক্রেতা-বিক্রেতা। ক্রেতা বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম ফেরিঘাট এলাকা। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান, আড়তের সামনে রাখা স্তূপে ১০০ হতে ১৫০টি আলাদা আলাদা সাইজের তরমুজের ছোট ছোট স্তুপ করে ডাকছেন বিক্রির জন্য। তরমুজ ডাকের সময় এসময় দুরন্ত হতে আসা পাইকাররা ডাকের স্থানে ভিড় করছেন। এসময় একজন প্রতি পিছ তরমুচের দাম ডাকতে শুরু করেন। বড় তরমুজ গুলো প্রথমে ২০০ শত টাকা করে ডাকা শুরু হয়। এক পাইকার ২০০ টাকায় নিতে রাজি হলে তখন আবার যিনি ডাকতে তিনি একই তরমুজ ২১০ টাকা পিচ বলে ডাকতে শুরু করেন। ২১০ টাকায় আবার কোন পাইকার নিতে রাজি হলে তখন তিনি একই তরমুজ ২২০ টাকা করে ডাকতে শুরু করেন। এভাবেই তরমুচের সর্বোচ্চ ডাকা দামে যে কিনতে রাজি হয় তার কাছে একসাথে বিক্রি করা হয় স্তুপের ১০০/১৫০টি তরমুজ।রবিবার দুপুরে এই আড়ৎতে তুলনামূলক বড় তরমুজ গুলো প্রতিপিচ ২২০-২৫০টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি সাইজের তরমুজ ১৫০-১৮০ টাকা এবং একবারে ছোট সাইজের তরমুজ ৫০ থেকে ৮০ টাকা হিসাবে বিক্রি হচ্ছিল।স্থানীয়রা ব্যবসায়ীরা বলেন , ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ট্রলার হতে শ্রমিকরা নামাতে শুরু করে তরমুজ ও বাঙ্গি। বিভিন্ন সময়ে তরমুজ চাষি ও ব্যবাসায়ীরা ট্রলারে ভরে তরমুজ বাঙ্গি এনে নদীর ঘাটে ভিড়িয়ে রাখেন। পরে তারা এ সমস্ত তরমুজ বাঙ্গি ভোর ৬টা হতে রাত ১২টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এখানকার আড়ৎগুলোতে তুলে বিক্রি করতে শুরু করেন। এককটা ট্রলারে ১০/১৫ হাজার তরমুজ থাকে। এ সমস্ত এক ট্রলার তরমুজ বিক্রি করতে দেখা যায় অনেকের কয়েকদিনও লেগে যায়। এসব বাঙ্গি-তরমুজ কেনার জন্য মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজিপুর থেকেও পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা এখানে ফল কিনতে আসেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধুম পড়ে যায় বেচা কেনার।এ হাটের আড়ত মালিক সমিতি,ব্যবসায় ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাত্র ৫ থেকে ৬ বছর আগে দু-একজন আড়তদার এখানে আড়ত পেতে বসেন। সে সময় দু-চারজন ব্যবসায়ী ও কৃষক তাঁদের উৎপাদিত বাঙ্গি-তরমুজ নিয়ে আসতো । তখন ক্রেতা ও বিক্রেতা ছিল খুব কম। তবে গত দু বছরে পাল্টে গেছে এ চিত্র। ব্যাপকভাবে বেড়েছে ক্রয় বিক্রয়। বেড়েছে আড়ত, ক্রেতা-বিক্রেতা। প্রতিদিন বরিশাল, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, রাঙাবালী থেকে এক এ হাটে আসে প্রায় ২ লক্ষ তরমুচ আসে । মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলাসহ, কুমিল্লা, চাঁদপুর থেকে আসে ভাঙ্গি। মুন্সীগঞ্জে পুরো জেলা ছাড়াও, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুর ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার কয়েক শতাধিক ফল ব্যবসায়ীরা নিয়মিত এ হাটে আসেন। ব্যবসায়ীরা এ হাট থেকে পাইকারি তরমুজ-ভাঙ্গি কিনে ফলের দোকান, শহরের রাস্তা,বাজার, গ্রাম, পাড়া-মহল্লার অলিগলি ও ভ্যানে করে বিক্রি করেন।বরিশাল জেলার রাঙ্গাবালী এলাকার তরমুজ চাষি বায়েজিদ বলেন, আমরা বরিশাল হতে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা ট্রলার ভাড়া নিয়ে ৬ জন কৃষক ১০ হাজার তরমুজ বিক্রি করতে এ আড়ৎতে আসছি। এ আড়ৎতে তরমুজের দাম ভালো। এখানকার পরিবেশও ভালো। এবার এখানে প্রথম আসছি আবারো তরমুজ নিয়ে আসবো। তরমুজ নিয়ে আসতে ট্রলারে ১২ ঘণ্টা সময় লাগছে। তবে তরমুজ নিয়ে আসর সময় রাস্তায় জেলেরা নৌকা হতে জোড় করে তরমুজ নিয়ে যায়।এই আড়ৎতে তরমুজ কিনতে আসা রফিক হোসেন বলেন, আমি প্রতিদিন এখান হতে তরমুজ বাঙ্গি কিনে ভ্যানে করে নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুর এলাকায় নিয়ে বিক্রি করি। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনের তুলনায় তরমুজ বাঙ্গির দাম এখনো অনেকটাই কম।বরিশাল রাঙ্গবালী এলাকার অপর তরমুষ চাষি রহিম খাঁ বলেন, ৫ একর জমিতে তরমুজের চাষ করেছি। এ বছর প্রায় ১০ হাজার তরমুজ বিক্রি করছি। আরো তরমুজ আছে। আগে ঢাকার আড়তে তরমুজ বিক্রি করতাম। তবে ঢাকার চেয়ে এখানে তরমুজের চাহিদা বেশি। ঢাকায় দাম ভালো পাওয়া গেলেও আড়তদারর তরমুজ জমিয়ে রেখে নষ্ট করে ফেলতেন। এছাড়া ঢাকার শ্রমিকরাও তরমুজ চুরি করত। এতে লাভের পরিবর্তে লোকসান গুনতে হতো। এ হাটে তরমুজের চাহিদা বেশ ভালো থাকায় তরমুজ জমে থাকেনা । চুরি ও নষ্ট কোনোটাই হয়না। তাই চিন্তা করছি আগামীতেও এ হাটে তরমুজ নিয়ে আসবো। তরমুজের পাইকার ফালান মিয়া বলেন,৩৫ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন জেলার কৃষকদের কাছ থেকে বাঙ্গি-তরমুজের কিনে ঢাকা,নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন আড়ৎতে বিক্রি করে আসছি। ৮-১০ বছর আগে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি ঘাট এলাকায় ও এ তরমুজের ব্যবসা করতাম। এখন সবচেয়ে বড় মৌসুমি ফলর আড়ত এটি। তিনি বলেন এ আড়তে দাম,সুযোগ সুবিধা ভালো। তাই গত ৫ বছর ধরে এ হাটে বাঙ্গি-তরমুজ বিক্রি করছি।ফল বিক্রেতা তপন দাস বলেন, এ মৌসুমি অন্যান্য ফলের তুলনায় তরমুজের চাহিদা বেশি। রমজান মাসে হওয়ায় চাহিদা আরো বেড়েছে। ঢাকা,নারায়ণগঞ্জের তুলায় এ হাটে তরমুজের দাম,মান দুটোই ভালো।আলিফ সাইফ ভাণ্ডার এন্টারপ্রাইজের মালিক আলামিন মুন্সী বলেন, এখানে বরিশাল অঞ্চল থেকে তরমুজ আসে। আসার পরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এখান থেকে তরমুজ কিনে নিয়ে যান। এখান থেকে তরমুজ কিনে নিয়ে যেতে পাইকারদের কোন সমস্যা হয়না। প্রতিদিন আমাদের এখানে কয়েক কোটি টাকার তরমুজ বাঙ্গি বিক্রি হয়। তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন ভোর হতে তরমুজ বেচাকেনা শুরু হয় রাত ১২টা পর্যন্ত কেনা-বেচা চলে।অপর আড়তদার আইয়ুব আলী বলেন, এখানেই সকাল হতে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রতিদিন তরমুজ বাঙ্গি কেনা-বেচা হয়। কয়েক কোটি টাকা প্রতিদিন বেচাঁকেনা হয় । দুর দুরান্ত হতে পাইকাররা এসে মালামাল নিয়ে যায়। এখান হতে সারাদেশে নদী ও সড়ক পথে যোগাযোগ করা খুব সহজ। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতা বিক্রেতারা সহজে এসে এখান হতে তরমুজ বাঙ্গি কিনে নিয়ে যান।এই আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ও হাজী আব্দুল মন্নাফ সুপারমার্কেটের স্বত্বাধিকারী মো.গোলাম ফারুক  বলেন, আমাদের এই আড়ত বর্তমানে ১২ জন আড়তদার রয়েছে। বর্তমানে বাঙ্গি-তরমুজের জন্য এ স্থানটি মুন্সীগঞ্জ জেলার মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ । ৫ বছর যাবৎ এ হাটে সবচেয়ে ভালো মানের তরমুজ বাঙ্গি পাওয়া যায়। মুন্সীগঞ্জ জেলা ছাড়াও ঢাকা,নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ফল কিনে নিয়ে যান।তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন এ হাটে এক লাখেরও বেশি তরমুজ বিক্রি হয়। যার মূল্য ১ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও ৫-৬ লাখ টাকা বাঙ্গি,কয়েক লাখ টাকার কলা ও খেজুরও বিক্রি হয়। তিনি আরো বলেন, মূলত তরমুজ বাঙ্গি এ সিজনে দেড় মাস এখানে বেচাঁকেনা খুবই জমজমাট হয়। অন্য মৌসুমে মৌসুমি ফল এখানে বেচাঁকিনা হলেও এই মৌসুমটাই সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে।