রাজধানীতে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ধসে পড়বে এক লাখ ভবন


বাংলাদেশ বড় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। চলতি বছরে দেশব্যাপী এ পর্যন্ত ১১টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। সর্বশেষ সোমবার ঢাকাসহ সারা দেশে ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ছোটখাটো ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস দেয়। তাই, যে কোনো সময়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা। এখানে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে লক্ষাধিক ভবন ধসে পড়বে। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালানোর সুযোগ থাকবে না। এই অবস্থায় এমন দুর্যোগের আগেভাগেই প্রস্তুতির তাগিদ দিয়েছেন তারা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, কয়েকদিনের ব্যবধানে ছোট ছোট কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। ১০-১২ বছরের মধ্যে যে কোনো সময় বড় ভূমিকম্প হবে। ভূমিকম্প হলে অনেক ফায়ার স্টেশনও অচল হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে সম্প্রতি ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগেরই উৎস সীমান্তের ওপারে মেঘালয় ও আসামে। ভূকম্পনের প্রধান উৎস হচ্ছে সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার ডাউকি ফল্ট। এই ফল্টের কারণেই দফায় দফায় ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূতত্ত্ববিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সাবডাকশন জোনে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি জমা আছে। যে কোনো সময় সে শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। রাজধানী থেকে উৎসস্থল ডাউকি ফল্টের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার এবং ভারত ও বার্মা প্লেটের সাবডাকশন জোনের দূরত্ব অন্তত ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে ঢাকাতে। কারণ এখানকার নগরায়ণ অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত। অনেক কাঠামোও দুর্বল। ঢাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, তাই আগে থেকেই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, বিভিন্ন দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করেন। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। অথচ আমরা অনেকেই তাদের চিনি না। তিনি বলেন, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মানুষের পরিচয় থাকতে হবে। তাদের আরও বেশি বেশি দুর্যোগ মোকাবিলার ট্রেনিং করাতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রত্যেককেই ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ড. দিলারা জাহিদ বলেন, আমরা অনেক বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছি। এটা যেভাবে আলোচনায় আসে সেভাবে বিশ্বাস করি না। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে ভূমিকম্প হতে পারে। এর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো এখনই ভূমিকম্প সহনীয় করতে হবে। ধীরে চলো নীতি ভূমিকম্প দুর্যোগের ক্ষেত্রে চলবে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভূমিকম্পের পূর্ব কোনো প্রস্তুতি নেই। বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে উদ্ধার সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে আমাদের আরও প্রস্তুতি ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ইন্ডিয়া প্লেট, বার্মা প্লেট ও এশিয়া প্লেট। উত্তরে এশিয়া, পশ্চিমে ইন্ডিয়া ও পূর্বে বার্মা প্লেট। ইন্ডিয়া প্লেট ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। সুনামগঞ্জ কিশোরগঞ্জ হাওড় হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে এই সাবডাকশন প্লেট। এটাকে ভূতত্ত্ববিদরা সাবডাকশন জোন বলেন। সাবডাকশন জোনের প্লেটগুলো খুবই বিপজ্জনক। যা খুবই শক্তিশালী ও জানমালের বেশি ক্ষয়ক্ষতি করে। ওই গবেষণার সময় ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ২৫টির মতো জিপিএস বসানো হয়। তার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ভূ-তত্ত্ববিদরা দেখতে পান যে, এই সাবডাকশন জোনে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমা আছে। এই শক্তি যে কোনো সময়ে বের হয়ে আসতে পারে। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় ভূমিকম্প হওয়ার মতো দুটি উৎস রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ডাউকি ফল্ট, অন্যটি হলো সাবডাকশন জোন। সাবডাকশন জোনটি উত্তরে সিলেট থেকে দক্ষিণে কক্সবাজার, টেকনাফ পর্যন্ত। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এ সাবডাকশন জোন। এই জোনে গত ৮০০ থেকে হাজার বছরে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। এর দক্ষিণে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার অংশে ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। সেই ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন ডুবন্ত দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে আসে। তাছাড়া সীতাকুণ্ড পাহাড়ে কাদাবালুর উদ্গিরণ হয়।