রিজার্ভ নিয়ে কঠোর অবস্থানে আইএমএফ


রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতার কারণে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কোনো পদক্ষেপেই দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় ঠেকাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভ ধরে রাখার ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ভুল নীতিকেই দায়ী করেছে আইএমএফ। একই সঙ্গে মিশন শেষের আগে রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা চেয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া খেলাপি ঋণের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ, খেলাপিদের কোনো সুবিধা না দেওয়া ও অর্থ পাচার ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। সোমবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে ঢাকায় সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল এসব তথ্য চেয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, চার ডেপুটি গভর্নর, মুখপাত্র ও বিভিন্ন বিভাগের নির্বাহী পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভ ধরে রাখায় ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন ভুল নীতিকেই দায়ী করেছে আইএমএফ। একই সঙ্গে বারবার সময় নেওয়ার পরও কেন রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্য এবং লক্ষ্য পূরণে কী কী বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা চেয়েছে আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থা। এ ক্ষেত্রে আগামী বৈঠকের (৮ মে) আগেই এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, সোমবার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের পরামর্শে বিপিএম-৬ অনুযায়ী হিসাবে তা ১৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। এটি অবশ্য প্রকৃত রিজার্ভ নয়। আর প্রকৃত ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ বের করতে বিপিএম ম্যানুয়াল থেকে চলতি দায় বাবদ আকু বিল, বৈদেশিক পাওনা, প্রকল্প বকেয়া বিল এবং বিশেষ পরিপূরক মুদ্রার (এসডিআর) বকেয়া হিসাবে ৫ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। সেই হিসাবে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে গড় আমদানি ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, ৫ দশমিক ২০ বিলিয়ন এবং ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। চলতি পঞ্জিকা বর্ষের মার্চ মাসেও প্রকৃত রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। মার্চ শেষে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু বাস্তবে ছিল প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুনে ২৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও নিট রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশে কোনো গলদ রয়েছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে মামলায় আটকা, পুনঃতফশিল ও অবলোপনকে ব্যাংকের খারাপ সম্পদ হিসাবে গ্রাহকদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে কিনা সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে খেলাপিদের বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সুবিধা দিচ্ছে কিনা তাও সংস্থাটিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। যদি খেলাপিদের ব্যাপারে কোনো উদারতা দেখানো হয় সেখান থেকে ফিরে আসতেও বলা হয়েছে। যদিও সম্প্রতি পুনঃতফশিল ও অবলোপন নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা নীতিমালার বিষয়ে তেমন কোনো মন্তব্য করেনি আইএমএফ। এছাড়া দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য চেয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি অর্থ পাচার ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য ও পাচার ঠেকাতে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানায় সংস্থাটি। আইএমএফের ঢাকায় সফররত দল তাদের মধ্যবর্তী ভিজিট সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ৩ দফায় বৈঠক করেছে। এছাড়া ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালা নিয়ে পলিসি অ্যাডভাইজার আবু ফরাহ মো. নাসেরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছে। বিভিন্ন বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইস্যু ছাড়াও রাজস্ব ঘাটতি অনেক বেশি হওয়ায় এই ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যান্য চুক্তি সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার স্বাক্ষর করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মুদ্রা বাজার ব্যবস্থাপনা, রিজার্ভ, খেলাপি ঋণসহ অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। তবে রিজার্ভে অব্যাহত ক্ষয়ে তারা উদ্বিগ্ন। সেক্ষেত্রে ক্ষয় ঠেকাতে নতুন কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সে বিষয়েও তারা জানতে চেয়েছেন। তবে এটি ঋণের কিস্তি ছাড়ে বাধা হবে না বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আইএমএফ রিজার্ভে লক্ষ্যমাত্রা আবারও রিভিউ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, রিজার্ভের বর্তমান অবস্থা, বিনিময় হার এবং স্মার্ট রেট নিয়ে কথা বলেছে আইএমএফ টিম। বিশেষ করে আর্থিক খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে তারা জলবায়ু খাতে বিনিয়োগের জন্য একটি মডিউল তৈরি করতে বলেছে।