নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে পাঁচ চ্যালেঞ্জ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকছে না ‘ডাবল শিফট’

*শিখন ঘাটতি দূর করতে শনিবারেও চলবে এ শিফটের বাড়তি ক্লাস *শিক্ষার সার্বিক মান বাড়ানোর ওপর জোর


দেশের ৪৬৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উঠে যাচ্ছে ‘ডাবল শিফট’ প্রথা। আগামী বছর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণি (এন্ট্রি ক্লাস) থেকে দুই শিফটের অধীনে শিক্ষার্থীভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরবর্তী বছর এর প্রয়োগ শুরু হবে সপ্তম শ্রেণি থেকে। এভাবে ধাপে ধাপে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই শিফটের সবগুলো ক্লাসেই (ষষ্ঠ-দশম) শিক্ষার্থীভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। দুই শিফটের অধীনে নতুন করে কোনো শিক্ষককে আর এমপিও দেওয়া হবে না। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি দূরতে করতে শনিবারও ক্লাস নেওয়া হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে পাঁচ চ্যালেঞ্জ সামনে উঠে আসায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সবমিলে সারাদেশে দুই শিফটে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক শিফটে রূপান্তরিত করে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র আরও জানায়, গত ২১ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডাবল শিফট প্রথা তুলে দেওয়া হবে। পাশাপাশি নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালার ধারা ৮.১ বাতিল করা হবে। মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। সভায় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব, মাউশি মহাপরিচালক, এনসিটিবি, এনটিআরসিএ ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সবার সম্মতিক্রমে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) রবিউল ইসলাম গতকাল রোববার বলেন, দুই শিফট প্রথা যেকোনো শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। এতে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি করে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য কন্টাক্ট আওয়ার (শ্রেণি ঘণ্টা) কম বরাদ্দ থাকে, এতে শিখন ঘাটতি থেকে যায়। দুই শিফটের ক্লাসে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা কঠিন। এজন্য আগামী বছর ষষ্ঠ শ্রেণি (এন্ট্রি ক্লাস) থেকে ‘দুই শিফট’ প্রথা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বেশকিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দেওয়ায় সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি পত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ওই পত্রে এনসিটিবি পাঁচটি চ্যালেঞ্জের কথা জানায়। চ্যালেঞ্জগুলো হলো- দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিখনঘণ্টা অনুসরণ না করা, মূল্যায়নে বাধাগ্রস্ত, শিক্ষকের কাজে ব্যাপক চাপ তৈরি, শিক্ষার্থীর শ্রেণির বাইরের কাজে বাঁধাসৃষ্টি এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোতে যানজটসহ সামাজিক অনেক সমস্যা তৈরি হওয়া। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক শিফটে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি (ননএমপিও-এমপিওভুক্ত) মিলে দুই শিফটের মোট ৪৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি মাধ্যমিকে ১৬৫টি আর বেসরকারিতে ৩শ’টি। আর দুই শিফটের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট ৭ লাখ ৫২ হাজার ৩৪১ জন শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। এর মধ্যে সরকারিতে ২ লাখ ৭০ হাজার ২১৭ জন আর বেসরকারিতে ৪ লাখ ৮২ হাজার ১২৪ জন। এতে মোট ১৫ হাজার ৬৯৪ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন।

জানা যায়, দুই শিফটে থাকা স্কুলগুলোর প্রথম শিফটে ক্লাস চলে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস চলে ১২টা ১৫ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত। অবশ্য রাজধানীর স্কুলে ক্লাস চলে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল পৌনে ৩টা পর্যন্ত। এর মধ্যে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত প্রথম শিফট এবং ১০টা থেকে বিকেল পৌনে ৩টা পর্যন্ত দ্বিতীয় শিফট। দুই শিফটের এসব স্কুলের কোনটিতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি, কোনটিতে তৃতীয় থেকে দ্বাদশ, আবার কোনটিতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত রয়েছে। মাউশি জানায়, এক শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিঘন্টা ৬ ঘণ্টা। আর ডাবল শিফটের ৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ডাবল শিফটের কন্টাক্ট আওয়ার কম বরাদ্দ থাকায় ঘাটতি পুষিয়ে নিতে শনিবারও ক্লাস রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর সৈয়দ জাফর আলী বলেন, দুই শিফটের স্কুলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ নতুন শিক্ষাক্রমে একটি শ্রেণিঘণ্টার জন্য ৫০ থেকে ১ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রয়েছে। যা নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে কাভার করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর শিখন সময় রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিখ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এজন্য দুই শিফটের স্কুলগুলোকে এক শিফটে নিয়ে আসার এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী বছর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণি (এন্ট্রি ক্লাস) থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হবে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।

শিক্ষাবিদ ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই শিফটের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেকোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্যই চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতকতা ২ ভাগ প্রতিষ্ঠানে দুই শিফট চালু রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ এখনও বড় মাত্রার সমস্যা তৈরি করেনি। তবে সার্বিকভাবে এটি শিক্ষার মান অর্জনে বড় বাঁধা। তাই দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক শিফটে নিয়ে আসা জরুরি। নতুন শিক্ষাক্রম যেহেতু নমনীয় তাই শ্রেণির শিখন ঘাটতি দলীয় ও একক বাড়ির কাজের মাধ্যমে আপাতত পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাকে এক শিফটে রূপান্তরিত করে শিক্ষার সার্বিক মান বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এনসিটিবি দুই শিফটের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে পাঁচটি চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছে। অন্যথায় নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।

শিখন ঘণ্টা অনুসরণ করা মুশকিল
এনসিটিবির কারিকুলাম উইং জানায়, দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এনসিটিবি প্রদত্ত রুটিন অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। নতুন শিক্ষাক্রমে একটি শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনায় ৫০ থেকে ১ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রয়েছে। যা পূর্বের শিক্ষাক্রমেও ছিল। শিক্ষার্থীর শিখন সময় রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে শিখন ঘাটতি থেকে যায়। তাছাড়া শিখন সময় কমে যা দাঁড়ায় তা আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

মূল্যায়নে বড় বাঁধা
এনসিটিবি বলছে, যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এজন্য প্রতিটি শিখন অভিজ্ঞতার বিভিন্ন পর্যায়ে এবং শেষ হবার পরে পারদর্শিতার নির্দেশক অনুযায়ী প্রত্যোক শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা অর্জনের স্তরে নির্ধারণ করতে হয়। এই কাজ করার জন্য শিক্ষাক্রমে নির্দেশিত সময় শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দুই শিফটে শিক্ষক সেই সময় পান না বিধায় যথাযথভাবে শিখনকালীন মূল্যায়ন সম্পন্ন করতে পারেনা। ফলে শিক্ষক দায় সাড়াভাবে তা করেন।

শিক্ষকের কাজে ব্যাপক চাপ
এনসিটিবি জানায়, দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধিক শিক্ষার্থী হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে একই শিক্ষককে একাধিক শিফটে ক্লাস নিতে হয়। ফলে তাদের কাজের চাপ বেড়ে যায় এবং দক্ষতার মান কমে যায়।

শ্রেণির বাইরের কাজে অংশ নিতে অনিচ্ছুক
এনসিটিবির কারিকুলাম উইং জানায়, দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি শিফট শেষ হলেই আরেকটি শুরু হয় বলে শিক্ষার্থীদের শ্রেণির বাইরের কাজে অংশগ্রহণে চ্যালেঞ্জ হয়্ এটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কাজে চ্যালেঞ্জ হবার পাশাপাশি তাদের সামাজিক-আবেগিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ স্কুল শুধু পাঠগ্রহণ করার স্থান নয়, সেই সাথে তার সামাজিকীকরণ, বাস্তবজীবনকে অনুধাবণ এবং বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াতে শেখার স্থানও। দুই শিফটের স্কুলে শিক্ষার্থী এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু তাই নয়, দুই শিফটের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ঘনবসতির কারণে গড়ে উঠেছে। নগরায়ণের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা সম্ভব ছিল না বিধায় বিদ্যমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দুই শিফট চালু করে আপদকালীন সমাধান করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি যানজটসহ সামাজিক অকেন সমস্যাও তৈরি হচ্ছে।