সুদ ভর্তুকি বেতন ব্যয়ের চাপ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম ৭ মাসে ঋণের সুদ, ভর্তুকি-নগদ সহায়তা এবং চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ ব্যয়ে বেশ চাপে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় বাজেটের পরিচালন খাতে ৯১ শতাংশই ব্যয় হয়েছে এ তিন খাতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছে ভর্তুকি-প্রণোদনা-নগদ সহায়তা খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় সুদ খাতে। আবার ভর্তুকির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত আরও ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যদিও আইএমএফ বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের শর্তে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে বলেছে।কিন্তু এ বিষয়টি খুব বেশি আমলে নেয়নি বর্তমান সরকার। তবে ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় ও ভর্তুকি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বরাদ্দ অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ ব্যয়ের বিপরীতে আশানুরূপ রাজস্ব আদায় বাড়েনি। চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নসংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি সংশোধিত বাজেটে পরিচালনা খাতে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এর মধ্যে জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই ৭ মাসে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। যা মোট পরিচালন খাতে বরাদ্দের ৪৪ শতাংশ। এই ব্যয়ের মধ্যে সরকারের ঋণের সুদ, ভর্তুকি ও বেতন-ভাতায় ব্যয় হয় ২ লাখ ৩ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা, মোট পরিচালন ব্যয়ের ৯১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে ভর্তুকি-প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা খাতে, যা টাকার অঙ্কে ৯১ হাজার ১৪ কোটি টাকা। এরপর ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৭৫ হাজার ৯০২ কোটি এবং সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় গেছে ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ জানান, সঞ্চয়পত্র এবং ট্রেজারি বিল থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে এ খাতের ব্যয় বেড়েছে। এসব ব্যয় মোকাবিলা করতে হলে সরকারের আয় বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। আর সেটি করতে হলে রাজস্ব আদায়ও বাড়াতে হবে এনবিআর সংস্কারের মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, সুদ ও ভর্তুকির ব্যয় এক ধরনের অর্থনীতিকে চাপের মধ্যেই ফেলবে। কারণ সেভাবে সরকারের আয় হচ্ছে না, রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। এই অর্থনীতিবিদের মতে, পরিচালন খাতে মোট বরাদ্দের ৪৪ শতাংশ গেছে ৭ মাসে। শেষ দিকে ব্যয়ের হিড়িক পড়ে যা সরকারের খরচের গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।মূলত বেশি ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কম মূল্যে গ্রাহকদের প্রদান, বিদেশ থেকে সরকারের প্রয়োজনে খাদ্যপণ্য ও সাশ্রয় মূল্যে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি পরিচালনা ও বেশি মূল্যে সার আমদানি করে কম মূল্যে কৃষককে প্রদানের মাধ্যমে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। এছাড়া উদ্যোক্তাদের মার্কিন ডলার দেশে আনার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে বিদেশে পণ্য রপ্তানির ওপর প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। আরও নগদ সহায়তা প্রদান করে জ্বালানি তেল আমদানিতে।অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৬৩ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও সংশোধিত বাজেট বাড়িয়ে ৮৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। যদিও এ সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের পরিপন্থি। এই সংস্থাটি বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে (যার মধ্যে দুই কিস্তি পাওয়া গেছে) সেখানে শর্ত আছে পর্যায়ক্রমে সরকারের বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনার। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন না করে সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকিতে আরও ২০ হাজার ২২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়। মূলত বিদ্যুৎ খাতে এ বছর বড় অঙ্কের ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয় বিদ্যুৎ খাতে, কিন্তু সংশোধিত বাজেটে সেটি বাড়িয়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এ বছর ভর্তুকির চাপ থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা কমে আসবে। ভর্তুকি ব্যয় বৃদ্ধির একটি কারণ হচ্ছে চলতি বরাদ্দের সঙ্গে পেছনের বকেয়াও যোগ হচ্ছে, যা আগামীতে হবে না।এদিকে প্রতিবছর ঘাটতি বাজেট পূরণে দেশীয় উৎস ব্যাংক, ট্রেজারি বিল ও বন্ড এবং বিদেশ থেকে ঋণ করতে হয়। এছাড়া সরকার সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এই ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বেশি হচ্ছে এ বছর। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৪০ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। বিপরীতে একই সময় ঋণের সুদ পরিশোধে গুনতে হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে গেছে ১০ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার এ বছর সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ করেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি হওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসাবে সঞ্চয়পত্রে বেশি ঋণ করে বেশি সুদ দিচ্ছে সরকার। যে কারণে সুদ পরিশোধে ব্যয় বেশি হচ্ছে।
