সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচন কী বার্তা দিল?


সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন শেষ হয়েছে। নতুন ফলাফল জানা গেছে। তাতে ১৪টি পদের মধ্যে সবক’টি পদেই আওয়ামী সমর্থক প্যানেল জয়ী হয়েছে। আওয়ামী প্যানেল জয়ী হয়েছে– কথাটি বললে অবশ্য সম্পূর্ণ সত্য বলা হয় না। অনেক সত্য আড়াল করা হয়। তাই বলা ভালো– আওয়ামী লীগের বিপক্ষের শিবির বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। কোন প্রেক্ষাপটে বিএনপি সরে দাঁড়িয়েছিল, সেটা বিস্তারিত বলার দরকার আছে বলে মনে করি না। তবে নির্বাচন ঘিরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের চিত্র কেমন ছিল, তা জানতে এক টেলিভিশন সাংবাদিকের বয়ানের দিকে নজর দিতে পারি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক জাহিদ হাসান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোটের সংবাদ সংগ্রহের সময় পুলিশের হাতে মারাত্মক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এটিএন নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার জাবেদ আখতার। জাবেদ ভাইকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে আহত হয়েছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সিনিয়র রিপোর্টার তানভী আপাও। আমি বেঁচে গেছি ভাগ্যক্রমে। একটা পিলারের সাথে দাঁড়ানো ছিলাম। পুলিশ হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। দেড়শ-দুইশ পুলিশের বাঁশির হুইসেল আর লাঠিচার্জ, চড়-থাপ্পড়। মুহূর্তের মধ্যে কী ঘটে গেল– কিছু বোঝার আগেই আমার ক্যামেরাম্যানকে টান দিয়ে গেটের বাইরে নিয়ে আসি।’ জাহিদ আরও লিখেছেন, ‘একটু পর যার দিকে তাকাই সে-ই আহত। বৈশাখী টিভির ক্যামেরাম্যানের পুরো টি-শার্ট ছিঁড়ে ফেলেছে মারতে মারতে। কারও আঙুল ফেটে গেছে, কারও পায়ে বুটের লাথি। আজকের পত্রিকার নুর মোহাম্মদ ভাই। কালবেলার কবির ভাই, ঢাকা পোস্টের মেহেদি হাসান ডালিম ভাইয়ের প্রতি চড়াও হয় পুলিশ। জাগো নিউজের ফজলুক হক মৃধা ভাইও আহত হন। জাবেদ আখতার দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ। তাঁর পায়ে সমস্যা। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। তিনি পুলিশকে অনুরোধ করার পরও তাঁকে যেভাবে কোনো কারণ ছাড়াই মেরেছে, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ডিবিসি, সময় টিভির ক্যামেরাম্যানও আহত হয়েছেন। একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা চোখের সামনে দেখার পর একটা কথাই মনে আসছে– সাংবাদিকদের মতো বিপজ্জনক পেশা আর নাই।’ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে সাংবাদিক জাহিদ হাসানের এই উপলব্ধি আমাদের দেশের পেশাগত বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের নজরে এসেছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দেখতে পেলাম, সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় ল রিপোর্টার্স ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে এসেছিলেন ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ডিআইজি হারুন অর রশিদ। সাংবাদিক জাহিদ তাঁর আরেক ফেসবুক পোস্টে একটি ছবি দিয়ে জানিয়েছেন– ডিআইজি হারুন অর রশিদ ডিএমপির কমিশনারের পক্ষ থেকেও সরি বলেছেন। কমিশনারকে আমাদের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক জানিয়েছেন। রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদের আচরণ সংশোধন ও অপেশাদার মানসিকতা পরিহার করার পরামর্শ তাঁর উপস্থিতিতেই আমরা দিয়েছি। আমার সাংবাদিক বন্ধুর উদ্দেশে বলতে চাই, পুলিশ অফিসারের অপেশাদার মানসিকতা ও আচরণ বদলানোর দায় কার– এই বিষয়ে আমাদের দেশে কোনো তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ বা অনুসন্ধান আছে কি? শুধু দুই-একটি ঘটনাতেই এডিসি হারুন বা ডিআইজি হারুনদের পেশাগত আচরণ আজকের এই পর্যায়ে আসেনি। এইবার সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবীর মতামত উল্লেখ করতে চাই। জহিরুল ইসলাম খান পান্না যিনি জেড আই খান পান্না নামেই এখন পরিচিত। পেশাগত কাজের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। সুপ্রিম কোর্টের ঘটনার পরে তাঁর মোবাইল ফোনে কল করি। ফোন ধরতেই তিনি ওপাশ থেকে বললেন: একজন আইনজীবী হিসেবে আমার লজ্জা হচ্ছে ভীষণ। অনেক বয়স হয়েছে। কয়েক যুগ ধরে আদালতে আছি। কিন্তু এইভাবে দেশের উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে, বার অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ঢুকে পুলিশ আমাদের পিটিয়ে যাবে– এটা কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও আসেনি। কত আমল দেখলাম! দেশে যখন স্বৈরাচারী সরকার ছিল, তখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। এবারই প্রথম ঘটল। কিন্তু পুলিশের হামলার ঘটনা কি দেশে এটাই প্রথম? না। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি, বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ চড়াও হয়েছে। সবশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ ধরনের পুলিশি তৎপরতার পরে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বা উপাচার্যের অনুমতি নিয়েই পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে কার অনুমতি বা আহ্বানে পুলিশ প্রবেশ করেছে? সে ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি কি পুলিশ প্রবেশের বিষয়টি জানতেন না? সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবীদের নির্বাচন ঘিরে যা হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। এ ঘটনায় দুটি বিষয় পরিষ্কার প্রশ্ন করা দরকার। প্রথমত, নির্বাচনের বছরে সুপ্রিম কোর্টের মতো স্থানে গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশাদারি সংগঠনের নির্বাচন কেন এইভাবে সম্পন্ন করতে হলো? যে কোনো নির্বাচনে, যে কোনো প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনদের জয়ী হওয়াই কি পূর্বনির্ধারিত? শেষ প্রশ্ন হচ্ছে– দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মানবাধিকার সংগঠন, বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলে আসছিলেন– বাংলাদেশ পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বারের মধ্যে প্রবেশ করে পুলিশ যেভাবে আইনজীবী এবং দায়িত্বরত সাংবাদিকদের পিটিয়েছে, তাতে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল কিনা? সাম্য, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা একটি দেশ কীভাবে পুলিশনির্ভর দেশে পরিণত হতে পারে– এ ঘটনাটি দেখলে সেই জবাবও পাওয়ার কথা।