সুশাসন নিশ্চিত হলেই তৈরি হবে বিনিয়োগের হাব
অনলাইন নিউজ ডেক্স

বাংলাদেশে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা যায় তবে অবশ্যই এখানে বিনিয়োগের হাব তৈরি হবে। কারণ বিদ্যমান কতগুলো পারিপার্শ্বিক বিষয় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয়টি হচ্ছে শস্তা শ্রম। এটা দুনিয়ার অনেক দেশেই পাওয়া যায় না। এছাড়া বাংলাদেশে আরও বেশকিছু সম্ভাবনার ক্ষেত্র রয়েছে। শুক্রবার সঙ্গে আলাপকালে টেলিফোনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ এসব কথা বলেন।এর আগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ হাব হিসাবে রূপান্তরের কথা বলেছেন এনসিপি’র মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তখন তিনি বলেন, এ নিয়ে এনসিপি কাজ করছে।এনসিপির এ ধরনের কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে আলাউদ্দীন মোহাম্মদ আরও বলেন, আপনাদের বুঝতে হবে যে, বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সুশাসনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যা এতদিন বাংলাদেশে ছিল না। কিন্তু এখন আমরা যে সংস্কার এবং পরির্তনের কথা বলছি তা বাস্তবায়ন হলে অবশ্যই বিনিয়োগের একটা অনুকূল পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি হবে। এছাড়া সম্প্রতি বিডা চেয়ারম্যানের উপস্থাপনায় উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশ হলো দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রস্থল। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, আসিয়ানভুক্ত যে দেশগুলো রয়েছে সেগুলোর মিলনস্থল বা কেন্দ্রীয় স্পট। আমাদের এখানে হয়তো খনি বা বিপুল পরিমাণ তেলের মজুত নেই। কিন্তু যেসব সম্ভাবনাময় উপাদান রয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এতদিন এগুলো হয়নি।এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বিশ্বের অনেক জায়গায় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠিত। এখানে ঘুস ছাড়া কোনো কাজ হয় না। পুরো সিস্টেম দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে যারা এই সিস্টেমের সঙ্গে কাজ করতে পারবে তার বাইরে আর কেউ এখানে বিনিয়োগ করতে আসছে না। এগুলো কিন্তু বিনিয়োগ পরিবেশকে ব্যপকভাবে বাধাগ্রস্ত করে।তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনারা জানেন যে পুরো গুলশান এলাকাটি মূলত আবাসিক এলাকা। কিন্তু সেখানে হাজারো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবার সামনেই এটা ঘটছে। এগুলো কীভাবে সেখানে টিকে আছে তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। সবাই জানে এটা একটা সিস্টেম। অর্থাৎ এখানে আইনের বাইরে গিয়ে অনেক কিছুই করা যায়।আমি এখানে গুলশানের উদহারণটা এজন্য দিচ্ছি যে, কাগজে-কলমে আপনি কখনোই এর কোনো উত্তর পাবেন না। এছাড়া বাংলাদেশে এমন অনেক ব্যবসা আছে যা আইনি কাঠামোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে কীভাবে ঢুকবেন তা বুঝতেই পারবেন না। কিন্তু কার্যত ব্যবসা চলছে। এ ধরনের অস্বচ্ছ পরিবেশে কখনোই বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। আবার দেখবেন রাস্তার পাশে অথবা ফুটপাতে শত শত অবৈধ দোকান আছে। অথচ সেগুলো সরকার বৈধ করতে পারে না। ফলে বৈধ পথে ভাড়াও নিতে পারে না। এখানে ফুটপাত টিকে আছে পুলিশ এবং এলাকার মাস্তানদের টাকা দিয়ে। ফুটপাত থেকে তারা রীতিমতো ভাড়া আদায় করে। কিন্তু এসব থাকলে ওয়ালমার্টের মতো বৃহৎ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কেন আসবে। ব্যবসা করতে এসে তারা এখানে অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কেন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। কিন্তু যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে বড় বিনিয়োকারী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছন্দে আসবে।তিনি আরও বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছরের দিকে তাকালে দেখবেন এতকিছুর পরও কিন্তু বাংলাদেশে বেশকিছু বিনিয়োগ এসেছে। যেমন মাতারবাড়ী বা এমন আরও বেশকিছু মেগা প্রকল্প। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই মূলত ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিনিয়োগ। এগুলোও আসবে। তবে আপনাদের বুঝতে হবে এসব মেগা প্রকল্প দিয়ে কিন্তু বিপুল মানুষের ভাগ্য বদল কখনোই সম্ভব নয়।আমাদের যে মিলিয়নের বেশি ফ্রিল্যান্সার তার নিজ উদ্যোগে প্রত্যন্ত গ্রামে বসে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছে। মূলত তাদের জন্য বড় বড় বিনিয়োগ আনতে হবে। এজন্য প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ দরকার। এসব বিনিয়োগের সঙ্গে শিল্পেরও একটা অবিচ্ছেদ্য সংযোগ ঘটাতে হবে। এছাড়া আমরা যে বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করি এর পেছনে যে আরেক শিল্প আছে সেখানেও বিনিয়োগ আনতে হবে। অর্থাৎ পোশাকশিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের জন্যও কিন্তু বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ আসতে পারে।তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে আমাদের এখানে ধর্ম একটা ইস্যু। বিশেষ করে ধর্ম পালন, ধর্মীয় মতবাদ ইত্যাদি নিয়ে একটা বিভাজন আছে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী মালয়েশিয়াসহ অন্য মুসলিম দেশগুলোতে দেখবেন একজন নারী হাফপ্যান্ট এবং পাশেই আরেকজন হিজাব পরে অনায়াসে ফুটপাতে ব্যবসা করছে। তাদের মধ্যে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। একে অপরকে আক্রমণ করছে না। এটাকেই বলে সহাবস্থান। দেশের বৈচিত্র্য এবং বৈপরীত্যকে সমানতালে চলতে দিতে হবে। সমতার বিষয়টিকে একটা সমানরেখায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ সমাজে যে যেভাবে চলতে চায় তাকে সে জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু হলি আর্টিজানের মতো ঘটনার কারণে কিন্তু আমরা দেশটাকে আগের অবস্থানে এখনো টেক ব্যাক করতে পারিনি।তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে শস্তা শ্রমের ব্র্যান্ডিং আছে সেটা দিয়ে কিন্তু খুব বেশিদূর এগোনো যাবে না। কারণ একটা অর্থনীতি যখন মধ্যম আয়ের দিকে যাবে তখন শস্তা শ্রম কাঙ্ক্ষিত থাকবে না। টিকে থাকার জন্য এটা আমরা প্রত্যাশাও করি না। এক্ষেত্রে সুশাসনের আর কোনো বিকল্প নেই। বিদেশিরা বাংলাদেশে তখনই বিনিয়োগ করবে যখন তারা এখানে বসবাস এবং বিনিয়োগকৃত অর্থের বিষয়ে নিরাপত্তাবোধ করবেন।সুস্থ প্রতিযোগিতা সমাজে একটি সুস্থ পরিবেশকে স্বাগত জানায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডা. তাসনিম জারা বা এ রকম আরও অনেকে দেশ-বিদেশ থেকে এসে এনসিপিতে যোগ দিয়েছেন। এতে করে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের ইতিবাচক শক্তিগুলোকে যেমন তাদের মেধাবী তরুণ অংশকে এখন সামনে আনতে শুরু করেছে। এনসিপি এটাই চায়। যা কিছু হোক না কেন, মুক্ত আলোচনা এবং পারস্পরিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে হবে।বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আমাদের বিশেষভাবে সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের এখানে নিরাপত্তার একটা বড় স্টেকহোল্ডার হলো রাজনীতি। ফলে এই রাজনীতির যে সংস্কার এবং নতুন বন্দোবস্ত এটা ইতিবাচক পরিবর্তনকে ঘিরে। কিন্তু সাবেক সরকারের সময়ে যেভাবে জঙ্গি প্রতিরোধের কৌশল নিতে দেখা গেছে এর বিপরীতে দেশে একটা অস্থিতিশীল প্রেক্ষিত সবার অলক্ষ্যে তৈরি হয়ে গেছে।তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটা বিনিয়োগের হাব তখনই হতে পারে যখন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হবে। তারা যেভাবে বাংলাদেশকে দেখতে চায় তা যখন রাজনীতির মাঠে প্রতিফলিত হবে তখনই বাংলাদেশে আসলে পরিবর্তন আসবে। সেটা আসবে দেশে বিপুল বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে। ফলে সুশাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনীতি এবং স্বচ্ছ আইনি কাঠামো নিশ্চিত হবে তখন আমরা দেখব যে, সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ এ অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো বৈদেশিক বিনিয়োগ আনতে সক্ষম হবে।
