১৭ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে কারখানার আগুন


১৭ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে কারখানার আগুন
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) পোশাক কারখানার ভয়াবহ আগুন দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টা পর অবশেষে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শুক্রবার সকালে বিভিন্ন বাহিনী ‘অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড’-এর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে রাতভর আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীসহ সিইপিজেড, বন্দর, কেইপিজেড ও আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের ২৫টি ইউনিট। এছাড়া উদ্ধার সহায়তায় যোগ দিয়েছিল ২ প্লাটুন বিজিবি। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। আগুন লাগার কারণও জানাতে পারেনি কোনো সংস্থা। এদিকে এ দুর্ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এবং বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। শুক্রবার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করছেন ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক জসিম উদ্দিন ও বেপজার নির্বাহী পরিচালক আবদুস সোবহান। ভয়াবহ আগুনে প্রতিটি ইট থেকে গ্রিল পর্যন্ত পুরো অবকাঠামো পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। ওই ভবনে ৭০০-এর মতো শ্রমিক কাজ করতেন বলে বেপজা সূত্রে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সিইপিজেডের ১ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভবনের প্রথম থেকে চারতলা পর্যন্ত ছিল অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানা এবং পাঁচতলায় ছিল জিহং মেডিকেল কোম্পানির কারখানা। অষ্টমতলায় আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পর তা দ্রুত সপ্তম ও ষষ্ঠতলায় ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্টেশন থেকে ১৯টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। তবে আগুনের তীব্রতার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের বেগ পেতে হয়। শুরু থেকেই সিইপিজেডে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর একটি টিম ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে নৌবাহিনীর পাঁচটি ইউনিট এবং পরবর্তীতে বিমানবাহিনীর একটি ইউনিটও এতে অংশ নেয়। সন্ধ্যার পর আগুন ক্রমে নিচতলায় পৌঁছে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র উত্তাপে আশপাশের প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে পরিবেশ অসহনীয় হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনার বিস্তার এড়াতে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও শিল্পপুলিশের সদস্যরা ভবন ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন। আগুনের তীব্রতায় ভবনটি ধসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত অষ্টমতলার কিছু অংশ ধসে পড়ে, তবে আগুন আশপাশের ভবনে ছড়াতে পারেনি। রাত ১১টার দিকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলে আগুন দ্রুত নেভানোর সুযোগ তৈরি হয়। বৃষ্টির পানিতে উত্তাপ কিছুটা কমায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাছাকাছি গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালান। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। রাত ১২টার সময় ওই ভবনে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস রোবটও ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। সিইপিজেড সূত্রে জানা গেছে, অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল তোয়ালে ও ক্যাপ উৎপাদন করত, আর জিহং মেডিকেল কোম্পানিতে তৈরি হতো সার্জিক্যাল গাউন। দাহ্য পদার্থ বেশি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভবনের সর্বোচ্চ তলার গুদাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, একটানা ১৭ ঘণ্টা কাজ করেছেন উদ্ধারকর্মীরা। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেকে খুবই ক্লান্ত। তারপরও তারা আশপাশের বিভিন্ন কারখানার ভবনগুলো রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন ফ্লোর ছিল কেমিক্যালে ঠাসা : ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ওপরের চারটা ফ্লোরেই ছিল স্টোর। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এখানকার প্রডাক্টগুলো পুড়ে আরেকটা রাসায়নিক এজেন্টে পরিণত হয়েছে। এই বিল্ডিংটা দুই দিক থেকে খোলা ছিল। কিন্তু বাকি দুই দিকটা সেটব্যাক মানে বিল্ডিং কোডের নিয়মটা মেনে করা হয়নি। বিল্ডিংটা দীর্ঘক্ষণ ধরে পুড়ছিল। যার কারণে ৮০০ থেকে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে আরসিসি কলামের স্ট্রাকচারের স্ট্রেইন্থ ছেড়ে দিয়েছে। পঞ্চমতলা থেকে অষ্টমতলা পর্যন্ত এটা একটা স্যান্ডউইচ হয়ে ফ্লোরগুলো একাকার হয়ে গেছে। পাশাপাশি ভেঙে নিচে পড়ছে। যার কারণে একটু দূরে দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের সেফটি নিশ্চিত করে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। যার কারণে সময় লেগেছে। ঘটনাস্থলের পরিবেশ : সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভয়াবহ আগুনে ভবনটি পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। কঙ্কালসার ভবনের গ্রিল ও কাচের গ্লাস তুলার মতো উড়ে গেছে। একটি ইট-গ্রিলও অবশিষ্ট নেই। ভবনের চারদিকে শুধু পোড়া গন্ধ। ভবনটির পূর্ব ও উত্তর পাশের ছয়তলা ও ৭ তলা থেকে তখনো ধোঁয়া বের হতে দেখা যাচ্ছিল। ভবনের চারদিকে সেনা, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা অবস্থান করছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের চার থেকে অষ্টমতলা পর্যন্ত ছাদগুলো পুড়ে ধসে গেছে। ফাটল দেখা দিয়েছে পিলারগুলোতেও। তদন্ত কমিটি : অগ্নি দুর্ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এবং বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক জসিম উদ্দিন জানান, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তারা রিপোর্ট দেবেন। অপরদিকে বেপজাও পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবেন। জসীম উদ্দীন জানান, ‘৮০০ থেকে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভবনটি দাহ্য হয়েছে। ফলে ভবনের চারতলা থেকে ওপরের ছাদগুলো সব ধসে অনেকটা স্যান্ডউইচের মতো হয়ে গেছে।’ সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুস সুবাহান জানান, পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য আমরা একটি কমিটি করেছি। কমিটির সদস্যরা শনিবার থেকে কার্যক্রম শুরু করবেন। সাততলায় দুটি কারখানার গুদাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। ভবনটিতে মোট ৭০০ শ্রমিক কাজ করেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার অ্যালার্ম দিয়ে শ্রমিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফলে কেউ আহত বা অগ্নিদগ্ধ হননি। শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক : বৃহস্পতিবার লাগা আগুনের কারণে সিইপিজেডে কর্মরত অন্যান্য পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শ্রমিকরা বলছেন, অন্যান্য এলাকার পোশাক কারখানার চেয়ে সিইপিজেডে আগুন নির্বাপণে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তারপরও একটানা ১৭ ঘণ্টা লেগেছে আগুন নেভাতে। কারখানার ওপরের তলায় আগুন লাগার কারণে নিচের ফ্লোরগুলোর শ্রমিকরা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। না হলে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল। পোশাক শ্রমিক আবুল কালাম জানান, এখন পোশাক কারখানায় কাজ করতে ভয়ে আছি। কোন দিন কী ঘটে বলা যায় না। রাস্তার পাশে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসও কাছে ছিল। তারপরও তারা আগুনের কাছে অসহায় অবস্থায় ছিল। আমরা শ্রমিকরা এখন অনেকটা আতঙ্কে আছি।