চার কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও ঝুঁকি


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিন দিনের ব্যবধানে দুটি ব্যাংক বন্ধের ঘটনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী তোলপাড় চলছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক খাত নড়েচড়ে বসেছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন ঘটছে। ব্যাংক দুটি দেউলিয়া হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিটকয়েনসহ ডিজিটাল মুদ্রা) বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, স্টার্টআপ খাতে ছোট উদ্যোগে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ, গৃহায়ন খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। অনেকে বলছেন, ২০০৮ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতে এটি বড় ঘটনা। এ ঘটনায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সতর্ক হয়েছে। তারা ব্যাংকিং খাতে তদারকি আরও বৃদ্ধি করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কারণে ব্যাংক বন্ধ হয়েছে, সেসব কারণ বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে ঝুঁকি নেই। তবে দুর্বল যেসব ব্যাংক রয়েছে সেগুলোতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুশাসনের ঘাটতি। ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালকদের মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ। ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়া ও ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতিতে বড় ধরনের ফাঁকি। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু সংকট যতই হোক ইমেজ রক্ষার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যাংকই বন্ধ হতে দেয় না। নীতি সহায়তা দিয়ে সচল রাখে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ব্যাংকগুলোকে ভালো রাখতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, সব খাতে নিশ্চিত করতে হবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বড় অঙ্কের ঋণের তদারকি বাড়াতে হবে। কমাতে হবে খেলাপি ঋণ, ব্যাংকের সূচকের হিসাব করতে হবে সঠিকভাবে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে কারণে ব্যাংক বন্ধ হয়েছে, সেসব কারণ বাংলাদেশে বিদ্যমান নেই। তার নেতিবাচক কোনো প্রভাবও বাংলাদেশে পড়বে না। আমাদের দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো এ খাতে বিনিয়োগ করেই বিপদে পড়েছে। বৈশ্বিক মন্দায় এসব মুদ্রার দাম কমে যাওয়ায় তাদের সম্পদ কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষকসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়ক বসানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মন্দায় বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়। মার্কিন ব্যাংক দুটির এ খাতে বড় বিনিয়োগ ছিল। ফলে এ খাত থেকেই তাদের সম্পদ ব্যাপকভাবে কমে যায়। তারা স্টাটআপ খাতে ছোট উদ্যোগে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল। মন্দায় ছোট ব্যবসাগুলো সংকটে পড়ে। ফলে তাদের কাছ থেকে ঋণ ফেরত আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এতেও তাদের তহবিল সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। গৃহায়ন খাতে তারা বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করেছে। কিন্তু মন্দায় হাউজিং ব্যবসায় ধস নামে। ফলে এ খাতের বিনিয়োগ অর্থ ফেরত আসা কমে যায়। এছাড়া চড়া মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমস (এফআরবি) তাদের নীতি সুদের হার দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। আরও বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহ ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে তাদের খরচও বেড়ে যায়। এসব কারণে ব্যাংক দুটি আর্থিক সংকটে পড়ে। তাদের সম্পদের প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। এ খবর প্রকাশ হলে আমানতকারীরা টাকা তুলে নিতে থাকে। এ সময়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতি সহায়তার আওতায় ব্যাংকগুলোকে অর্থের জোগান দেওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে এ সংকট পুরো ব্যাংকিং খাতে ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমানতকারীদের স্বার্থে ব্যাংক বন্ধ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর জন্য বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলোতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। ফলে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগজনিত কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি নেই। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেপরোয়াভাবে নীতি সুদের হার বাড়ালেও বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি করেনি। তারা ধীরে ধীরে নীতি সুদের হার সামান্য বাড়িয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি পড়েনি। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে ও মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি করেছে। মন্দায় বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো খাতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর একতরফা বিনিয়োগ নেই। ফলে এ খাতের ঝুঁকি থেকেও ব্যাংকগুলো শঙ্কামুক্ত। তবে সুশাসন ও হিসাব পদ্ধতির দিক থেকে দেশের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি রয়েছে। কেননা এসব খাতে স্বচ্ছতার বড় অভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ শুধু নীতি প্রণয়ন করে। সেই নীতি বাস্তবায়ন করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তারা পর্ষদের বৈঠকে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়। এর আলোকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণ বিতরণ করে ও আমানত সংগ্রহ করে। এসব কাজে তারা হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ঋণ ও আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি প্রতি পর্ষদ সভায় তারা ঋণ অনুমোদন করে। নবায়নের প্রস্তাবও অনুমোদন করে। বড় অঙ্কের ঋণগুলোর সবই পর্যদের মাধ্যমে পাশ হচ্ছে। কিন্তু যখন খেলাপি হচ্ছে তখন পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক দেউলিয়া হলে পর্ষদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাংকের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল। মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওইসব খাত থেকে ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছিল না। যে কারণে তারা সংকটে পড়ে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকেও বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এগুলো একক গ্রুপ বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। নিয়মিত আদায় হচ্ছে না। খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। একটি বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্রাতিরিক্ত বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের কারণে কয়েকটি ব্যাংক সংকটে পড়ে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে চাহিদামতো টাকার জোগান দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা আপাতত রক্ষা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাপোর্ট না দিলে ব্যাংকগুলো বিপদে পড়ত। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে এ ধরনের কোনো সহায়তা দেয় না। যে কারণে বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প থাকে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক বন্ধের ঘটনা থেকে বাংলাদেশের দুটি বিষয় শিক্ষণীয় আছে। একটি হচ্ছে, আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধ করা ও আমানতের বিপরীতে বিমা সুবিধা বাড়ানো। এ বিষয়ে অচিরেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকের হিসাবে কারসাজি করে সম্পদ ভালো দেখানো হচ্ছে। একটি পর্যায়ে তা প্রকাশ হলে সংকটে পড়ে ব্যাংক। এগুলো ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক ভালো নেই। এতে সার্বিক অর্থনৈতিক ও ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতিতে রিটার্ন কমে যাচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিমা কাভারেজ বাড়াতে হবে। প্রিমিয়াম আরও বাড়াতে হবে। বিশ্লেষকরা জানান, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর যে অবস্থা তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নীতি সহায়তা না দিত তাহলে অনেক ব্যাংক সমস্যায় পড়ত। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। এগুলোকে আড়ালে রেখে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখানো হচ্ছে। সংকট যতই হোক বাংলাদেশে ব্যাংক বন্ধ করা হয় না। নীতি সহায়তা দিয়ে সচল রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক সংকটে পড়লে সেটি বাঁচাতে অর্থের জোগান বাড়িয়ে নীতি সহায়তা দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে নীতি সহায়তা দিয়ে এর আগে একাধিক ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো সফলভাবে এখন পরিচালিত হচ্ছে না। বাংলাদেশে ব্যাংক বাঁচানোর ক্ষেত্রে বলা হয়, ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু এর নেপথ্যে ব্যাংকের পরিচালকরা বেঁচে যায়। কোনো ব্যাংকে সংকটে পড়ার কারণে পরিচালকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। তাদেরকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি। অথচ সব কিছুর নেপথ্যে থাকেন পরিচালকরা। দেশে ব্যাংকিং খাতে পরিচালকদের পেশাগত দক্ষতা কম। অনেকের অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তারা পর্ষদে থেকেও ব্যাংক পরিচালনায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তেমনটি নেই। যুক্তরাষ্ট্রে আমনতকারীদের ১২ লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত বিমার আওতায় আছে। বাংলাদেশে আছে দুই লাখ টাকা।