আইন ভেঙে উপাচার্য ফরিদের রামরাজত্ব


সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজত্ব কায়েম করছেন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ-১৯৮৭ অনুযায়ী যেসব নিয়োগ বোর্ডে সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করার কথা উপ-উপাচার্যের, সেসব বোর্ডেও তিনি (উপাচার্য) সভাপতি হয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। আবার এসব বিষয় সিন্ডিকেটে অনুমোদনও করিয়ে নিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, এসব তিনি (উপাচার্য) করতে পারেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বলছে, উপ-উপাচার্য দায়িত্বে থাকাকালে উপাচার্য এটা করতে পারেন না। এটা আইনসিদ্ধ না। জানা যায়, ১৯৮৭ সালের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশের তফশিল অংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংবিধির ৬ নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগে বাছাই কমিটির সভাপতি হবেন উপাচার্য। এছাড়া সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি হবেন উপাচার্য। শর্ত থাকে যে, উপ-উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকিলে তিনি এই বোর্ডের সভাপতি হবেন। একই ভাবে ১৪ নম্বরে কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বলা হয়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, গ্রন্থাগারিক, মহাবিদ্যালয় পরিদর্শক এবং সমমর্যাদা-সমবেতনের অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাচার্য উক্ত বোর্ডের সভাপতিত্ব করবেন। উপরে উল্লিখিত কর্মকর্তা ব্যতীত অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগে উপ-উপাচার্য থাকলে উপাচার্য আর সে বোর্ডের সভাপতি থাকতে পারবেন না। ১০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কবির হোসেন। নিয়োগের শর্তানুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, গ্রন্থাগারিক, মহাবিদ্যালয় পরিদর্শক এবং সমমর্যাদা ও সমবেতনের অন্যান্য কর্মকর্তারা অথবা অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগে বোর্ড ব্যতীত সব ক্ষেত্রে তিনিই সভাপতি থাকবেন। কিন্তু সেই আইন মানেননি উপাচার্য। উপ-উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ২৮ আগস্ট পরিসংখ্যান বিভাগে ১ জন অফিস সহায়ক, ৫ সেপ্টেম্বর ই-বিজ্ঞান বিভাগে ১ জন অফিস সহায়ক, ৯ আগস্ট সিএসসি বিভাগে ২ জন প্রভাষক, ১০ আগস্ট আই.আই.সি.টি বিভাগে ২ জন প্রভাষক, ২৯ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর রেজিস্ট্রার দপ্তরে ২ জন অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর, ২ ও ৩ অক্টোবর বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের (নতুন হল) একজন করে হিসাবরক্ষক, হল সুপার ভাইজার, অফিস সহায়ক, অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং ৫ অক্টোবর পরিবহণ দপ্তর ৫ জন হেলপার/ড্রাইভার (আউটসোর্সিং) নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া সৈয়দ মুজতবা আলী হলে ১ জন টেকনিশিয়ান, ১ জন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, লাইব্রেরি দপ্তরে ১ জন ডেপুটি লাইব্রেরিয়ানও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব বোর্ডের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। এ সংক্রান্ত সব নথিপত্র হাতে এসেছে। শুধু তাই নয়, তিনি অবৈধভাবে সভাপতি হয়ে যে সব নিয়োগ দিয়েছেন তা আবার ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটে অনুমোদনও করিয়েছেন। এছাড়া অধ্যাপক থেকে শুরু করে এমএলএসএস পদে নিয়োগের প্রায় সব বোর্ডের উপচার্যের এলাকার একজন শিক্ষককে আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে আনা হয়। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষক মহল। একজন অধ্যাপক জানান, একজন যদি, উপাচার্যের কাছের ব্যক্তি হিসাবে সব নিয়োগে বোর্ড থাকেন তাতে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। যে দপ্তরের নিয়োগ সেই দপ্তরের কাউকে যদি উপাচার্য বেছে নিতেন তাতে বিষয়টির স্বচ্ছতা থাকত। এসব বিষয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, উপ-উপাচার্য আমাকে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন যে, আমি যেন এই নিয়োগ বোর্ডগুলোর সভাপতিত্ব করি। তাই করেছি। যদিও এসব কমিটিতে উপ-উপাচার্য নিজেও উপস্থিত ছিলেন। চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভাঙতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সিন্ডিকেটে তোলা হয়েছিল। সিন্ডিকেট অনুমোদন দিয়েছে। এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. কবির হোসেন জানান, তিনি যোগদান করার পর এখনো তার কক্ষ তৈরি হয়নি। সেভাবে নিয়োগ বোর্ডে বসার স্থান নেই। এখনো উপাচার্যের কক্ষেই বোর্ডগুলো হচ্ছে তাই তিনি উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে সভাপতিত্ব করার অনুরোধ করেছেন। এটা সিন্ডিকেটে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে এটা অবহিত করার তালিকায় রয়েছে। উপাচার্যের কথা অনুযায়ী সিন্ডিকেট সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আমেনা পারভিনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, উপ-উপাচার্য যে চিঠি দিয়েছেন তা সিন্ডিকেটে উত্থাপন হয়েছে কিনা? জবাবে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে তা মনে পড়ছে না। তবে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া এটা চিঠি দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না। অন্য এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, এমন কোনো চিঠি এবং উপ-উপাচার্য যে সভাপতিত্ব করেননি তা অবহিত করা হয়নি বলেই সিন্ডিকেট আইন অনুযায়ীই সবকিছু হয়েছে ধরে নিয়ে নিয়োগগুলোর অনুমোদন দিয়েছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিবর্তন করা যায় কিনা জানতে চাইলে মঞ্জুরী কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, উপ-উপাচার্য যদি কর্মস্থলে থাকেন, সে ক্ষেত্রে কোনোভাবেই উপাচার্য সভাপতিত্ব করতে পারেন না। তা কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ হবে না। আইনের এসব বিষয় জানতে সঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের। তিনি জানান, উপ-উপাচার্য চিঠি দিলে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। মন্ত্রণালয় যদি মনে করে সেটা করা উচিত তবে তিনি তা করতে পারবেন। তা না হলে আইন তো অনেক বড় বিষয়; নৈতিক দিক থেকেও তা ঠিক হয়নি।