অবশেষে ‘মোদি মডেল’ উন্মোচিত
অনলাইন নিউজ ডেক্স
বিবিসি-হিনডেনবার্গ পর্বটিকে ভারতীয় মিডিয়া ভারতের টুইন টাওয়ারের ওপর হামলা হিসেবে চিত্রিত করেছে; টুইন টাওয়ার মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারতের বৃহত্তম শিল্পপতি গৌতম আদানি। সম্প্রতি প্রচারিত বিবিসির দুই পর্বের ডকুফিল্ম মোদিকে গণহত্যায় প্ররোচনা দানের জন্য অভিযুক্ত করে; আর হিনডেনবার্গ রিপোর্ট, যা ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত, আদানিকে করপোরেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত করে। আদানি গ্রুপ অবশ্য তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।
মোদি ও আদানি একে অন্যকে কয়েক দশক ধরে চেনেন। বিবিসি গুজরাটে ২০০২ সালের মুসলিম গণহত্যার পর থেকে বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে শুরু করে; একটি রেল কোচ পোড়ানোর জন্য মুসলমানদের দায়ী করার পরিপ্রেক্ষিতে; যাতে ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী পুড়ে মরেছিলেন- ওই গণহত্যা শুরু হয়। গণহত্যার মাত্র কয়েক মাস আগে মোদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময় গুজরাটের শহর ও গ্রামের রাস্তায় \'প্রতিশোধ\'-এর নেশায় মত্ত হিন্দু উগ্রবাদীরা মুসলমানদের প্রকাশ্যে হত্যা এবং দলবদ্ধ ধর্ষণে লিপ্ত হয়, যা দেখে ভারতের বেশিরভাগ মানুষ আঁতকে উঠেছিল। এমনকি কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির কিছু পুরোনো মূল্যবোধধারী সদস্যও মোদির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই দৃশ্যপটে গৌতম আদানির প্রবেশ। গুজরাটি শিল্পপতিদের একটি ছোট গ্রুপ নিয়ে তিনি ব্যবসায়ীদের একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করেন, যা গুজরাটের পুনরুত্থান গ্রুপ নামে পরিচিত। তারা মোদির সমালোচকদের নিন্দা করেছিল। কারণ তাদের ভাষায়, মোদি ছিলেন হিন্দু-হৃদয় সম্রাট। আরও সঠিকভাবে বললে, হিন্দু ভোট ব্যাংকের একত্রীকরণকারী শক্তি।
২০১৪ সালে মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি একটি প্রাইভেট জেটে দিল্লিতে তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উড়ে এসেছিলেন, যার পুরো অংশে ছিল আদানির নাম লেখা। মোদির মেয়াদের ৯ বছরে আদানির সম্পদ ৮ বিলিয়ন থেকে ১৩৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। শুধু ২০২২ সালে তিনি ৭২ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন, যা বিশ্বের পরবর্তী ৯ বিলিয়নেয়ারের একত্রিত আয়ের চেয়েও বেশি।
বিবিসি ফিল্ম \'দ্য মোদি কোয়েশ্চেন\'-এর প্রথম পর্বে (আমি এতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য একজন সাক্ষাৎকার দানকারী হিসেবে উপস্থিত হয়েছি) গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে; এদের একজন ছিলেন ইমতিয়াজ পাঠান, যিনি গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যায় তাঁর পরিবারের ১০ সদস্যকে হারিয়েছিলেন। পাঠান বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তাঁরা সবাই উন্মত্ত আক্রমণকারীদের এড়ানোর জন্য কংগ্রেসের সাবেক সংসদ সদস্য এহসান জাফরির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, জাফরি নরেন্দ্র মোদির কাছে সাহায্যের জন্য আকুল হয়ে ফোন করেছিলেন। যখন জাফরি বুঝতে পেরেছিলেন- কোনো সাহায্য আসবে না, তখন তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে হামলাকারীদের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন এ আশায়- এতে অন্তত তাঁর কারণে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রাণ বাঁচবে। হিন্দুত্ববাদীরা জাফরিকে টুকরো টুকরো করে এবং তাঁর শরীর পুড়িয়ে দেয়।
গত বছরের ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্টে ফোনকলটি নিয়ে পাঠানসহ আরও কয়েকজনের সাক্ষ্যের বিপরীতে গুজরাট সরকারের বক্তব্যই প্রাধান্য পায় এবং মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। মোদির সমর্থকরা রায়টিকে মোদির নির্দোষ হওয়ার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে উদযাপন করেছে। বিবিসি কিন্তু এ বিষয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। সেখানে ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তব্যও দেখানো হয়েছে, যিনি মোদির আরেকজন পুরোনো বন্ধু বটে।
বিবিসি ডকুমেন্টারির দ্বিতীয় পর্ব তুলনামূলক কম লোক দেখলেও এতে আরও ভয়ংকর বিষয় তুলে ধরা হয়, যা ছিল মূলত মোদি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জনগণের মধ্যে যে বিপজ্জনক বিভাজন ও ঘৃণার চাষ করেছেন, তা নিয়ে। বেশিরভাগ ভারতীয়র জন্য এটি একটি দৈনন্দিন দৃশ্য, যেখানে তলোয়ারধারী জনতা এবং জাফরান রঙের পোশাক পরিহিত দেব-পুরুষরা মুসলমানদের হত্যা এবং মুসলিম নারীদের ধর্ষণের জন্য আহ্বান জানায় এবং দায়মুক্তির সঙ্গে হিন্দুরা মুসলমানদের রাস্তায় পিটিয়ে মারে। এ দৃশ্য ওরা নিজেরাই ভিডিও করে এবং মোদির মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যরা এ জন্য তাদের মালা পরিয়ে অভিনন্দন জানান।
যদিও ডকুফিল্মটি শুধু ব্রিটিশ দর্শকদের জন্য সম্প্রচার করা হয়েছিল এবং যুক্তরাজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি ইউটিউবে দর্শকরাই আপলোড করেছিল এবং লিংকগুলো টুইটারে পোস্ট করা হয়েছিল। ভারতে শিক্ষার্থীরা যাতে এটি ডাউনলোড করে না দেখে, তার জন্য তাদের সরকারের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। তারা যখন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তা দেখানোর ঘোষণা দেয়, তখন বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি পুলিশও এতে হস্তক্ষেপ করে। সরকার ইউটিউব এবং টুইটারকে সব লিংক এবং আপলোড মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়। বাকস্বাধীনতার সেই তারকা ডিফেন্ডাররা তা মেনে নিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেননি।
এর পর আসে দ্বিতীয় টাওয়ারে হামলা। চার শতাধিক পৃষ্ঠার হিনডেনবার্গ রিপোর্টটি বিবিসি ফিল্মের দ্বিতীয় পর্ব সম্প্রচারের দিনই প্রকাশিত হয়। এটি ভারতীয় সাংবাদিকদের দ্বারা অতীতে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিশদভাবে বর্ণনা করেছে এবং বিষয়টাকে আরও খোলাসা করেছে।
হিনডেনবার্গ রিপোর্ট অনুসারে, আদানির তালিকাভুক্ত সাতটি কোম্পানির ৮৫ শতাংশের বেশি শেয়ার অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে এবং ভারতীয় স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার মতো পাবলিক সেক্টর ব্যাংকগুলো থেকে বিলিয়ন ডলার ধার করেছে বলে জানা গেছে, যেখানে লাখ লাখ সাধারণ ভারতীয় তাদের আজীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছেন।
আদানি গ্রুপ ৪১৩ পৃষ্ঠার বক্তব্য দিয়ে হিনডেনবার্গ রিপোর্টের প্রতিবাদ জানায়। তারা দাবি করেছে, গোষ্ঠীটিকে ভারতীয় আদালত বহু আগেই তাদের এমন অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং হিনডেনবার্গের অভিযোগগুলো বিদ্বেষপূর্ণ, ভিত্তিহীন এবং ভারতের ওপর আক্রমণের সমান।
হিনডেনবার্গ রিপোর্টের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক ঝড় একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি দ্বারা তদন্তের দাবিতে বিরোধী দলগুলোকে একত্র করে। পার্লামেন্টের সদ্যসমাপ্ত বাজেট অধিবেশনে দুই বিরোধী দলের সংসদ সদস্য- সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের মহুয়া মৈত্র ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী, যাঁরা হিনডেনবার্গ রিপোর্টের অনেক আগেই আদানি গ্রুপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন; তাঁরা সংসদে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু মহুয়ার প্রশ্ন উপেক্ষা করা হয়, আর গান্ধীর অধিকাংশ প্রশ্ন ও বক্তব্য সংসদের রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়। অন্যদিকে মোদির উত্তর চলে পুরো ৯০ মিনিট।
তিনি নিজেকে একজন গর্বিত ভারতীয় হিসেবে তুলে ধরে বলেন, এটি আন্তর্জাতিক অশুভ প্রচারণা, যা কখনোই সফল হবে না। কারণ তিনি ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মানুষের আস্থা দ্বারা গঠিত প্রতিরক্ষাবর্ম পরেছেন, যা বিরোধীরা কখনোই ভেদ করতে পারবেন না। তিনি বলেছিলেন, পদ্মের (বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক) প্রতি যতই নোংরা নিক্ষেপ করা হোক, এটি ফুটবেই। তিনি একবারও আদানির নাম নেননি। হয়তো তিনি বিশ্বাস করেন, এটা ভোটারদের কোনো বিষয় নয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদের ধরন পাল্টে যায়। মিডিয়ায় নব্যসাম্রাজ্যবাদের মুণ্ডুপাতও থেমে যায়। একটি \'উষ্ণ ও ফলপ্রসূ\' বৈঠকের পরে মোদি, জো বাইডেন ও ইমানুয়েল মাখোঁ ঘোষণা করেন, ভারত ৪৭০ বোয়িং এবং এয়ারবাস বিমান কিনবে। বাইডেনের মতে, এর ফলে এক মিলিয়নের বেশি আমেরিকান চাকরি পাবে। এয়ারবাসগুলো রোলস-রয়েস ইঞ্জিনে চলবে। যুক্তরাজ্যের বিমান খাতের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, \'আকাশই শেষ সীমা।\'
তাই পদ্ম ফুটছে রক্ত ও অর্থের ডোবায়। তবে সত্য অবশ্যই স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করবে।
ডোনেট বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।