ঢাকার বায়ু নির্মল করতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ


বায়ুদূষণের চূড়ায় থাকার দুর্নাম নিয়ে তিলোত্তমা ঢাকা ধুঁকছে বছরের পর বছর। দিন দিন এই নগরের বাতাস হয়ে উঠছে আরও বিষময়! দূষণ রোধে একসময় আদালত ও মাঠে সমানতালে লড়াই চালানো পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাঁধেই এখন রাজধানী নির্মল করার দায়িত্ব। এ কারণেই পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই নেমে পড়েন দীর্ঘ বছরের জঞ্জাল সাফে। এত দিনের সমন্বয়হীনতা আর অব্যবস্থাপনার পাহাড় ঠেলে এবার নেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ সমন্বিত পদক্ষেপ। এ পটভূমিতে ঢাকার দূষণ কমানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে এক সুতোয় গেঁথেছেন সৈয়দা রিজওয়ানা। গঠন করেছেন টাস্কফোর্স।গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ ভবনে ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক সভা থেকে আসে সমন্বিত পদক্ষেপের ঘোষণা। ২০ বছরের পুরোনো বাস তুলে নেওয়া, রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিবন্ধনের আওতায় আনতে আইন প্রণয়ন, মহাখালী থেকে বাসস্ট্যান্ড তুলে দেওয়া, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, আশুলিয়াকে ‘নো ব্রিকফিল্ড’ করার চিন্তা, সড়ক বিভাজক ও অনাবৃত জায়গায় ঘাস লাগানোসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে।সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহাপরিচালক ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসকরা, বাস মালিক সমিতির নেতারা।সভা শেষে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, বায়ুদূষণ নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে আদালতে লড়াই করেছি, এখন সরকারে এসে কাজ শুরু করার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৫ সালে আদালত বলেছিলেন একটি এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান দিতে। এত বছর কিছু হয়নি। এখন এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান চূড়ান্ত হয়েছে। সমন্বয়হীনতা যেন না থাকে, সে জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বায়ুদূষণে ঢাকা শীর্ষে– এটা এই বছরই প্রথম শোনেননি। এটা ১২ বছর ধরে শুনে আসছেন, ৬-৭ বছর ধরে শীর্ষে শুনছেন। যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, তারা জনদুর্ভোগ কমাতে কাজ করবে। বায়ুদূষণ কমানো এক-দুই মাস, এক বছরের ব্যাপার নয়। চীনের মতো দেশেরও ১০ বছর লেগেছে দূষণ কমাতে। ধুলো, গাড়ির কালো ধোঁয়া, ইটভাটা, স্টিল মিল থেকে যে দূষণ হচ্ছে, তা কমিয়ে জনদুর্ভোগ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করতে পারি।তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়ক বিভাজক বা রাস্তার পাশের অনাবৃত জায়গা থেকে ধুলা ওড়ে। ওইটাকে নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে ঘাস লাগিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাস্তায় ঝাড়ু দিয়ে ধুলা একটি কোনায় ফেলে রাখা হয়। সেগুলো আবার গাড়ির চাকায় সারা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। অনেক ভাঙা রাস্তা আছে, যেখান থেকে ধুলা ওড়ে। সেগুলোও মেরামত করার জন্য বলা হয়েছে। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হবে। তবে আইন প্রয়োগে মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।মহাখালী থেকে বাসস্ট্যান্ড তুলতে হবে। আশুলিয়া থেকে বেশির ভাগ ইটভাটার ধোঁয়া আসে। আশুলিয়াকে নো ব্রিকফিল্ড জোন ঘোষণা করা যায় কিনা– ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।উপদেষ্টা বলেন, নিয়মিত পানি ছিটানো হবে, যদিও পানি ছিটিয়ে বায়ুদূষণ কমে না। এতে জনদুর্ভোগ কিছুটা কমে। আমরা মাস্ক পরার কথা বলছি। যাদের পক্ষে সম্ভব তাদের বাসায় এয়ার পিউরিফায়ার রাখার কথা বলছি। এটার অনেক দাম। তাই এসব পণ্যের ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়ার জন্য এনবিআরকে বলা হয়েছে। আশা করি, আগামী সপ্তাহে তারা কোনো ভালো সংবাদ আমাদের দেবে।বাস মালিকদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ঢাকায় মানুষ বায়ুদূষণে অসুস্থ হবে, মারা যাবে আর বাসগুলো দূষণ করবে–এটা চলতে দেওয়া হবে না। পুরোনো বায়ুদূষণকারী বাস তুলে স্ক্র্যাপ করা হবে।আগামী এক মাসের মধ্যে সেবায় উন্নতি করতে না পারলে দেশের পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানসহ সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ফিটনেসহীন যানবাহন রাস্তায় যেন চলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকায় যেসব জায়গায় যানজট হয়, সেগুলো চিহ্নিত করার কথা বলেন ফাওজুল কবির। তিনি বলেন, মে মাসের মধ্যে ২০ বছরের পুরোনো বাস ঢাকা থেকে তুলে দিতে হবে। এটা পরিবহন মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা যদি এ ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ পেতে আগ্রহী হয়, তাহলে সরকার তাদের সহযোগিতা করবে।ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যত্রতত্র পার্কিং, সুনির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী ওঠানামা না করা, পুরোনো ও ফিটনেসহীন যানবাহন ঢাকা শহরে যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম উপদেষ্টা স্বল্পকালীন সমাধান হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ে বা পিকআওয়ারে একমুখী যান চলাচলের ব্যবস্থা, পার্কিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সতর্কতার সঙ্গে কঠোরভাবে দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে উপদেষ্টা ঢাকা শহরের বাস টার্মিনাল এবং রেলওয়ে স্টেশন স্থানান্তরের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ঢাকাবাসীকে একটি সুন্দর ও নিরাপদ শহর উপহার দিতে আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী বলেন, রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিবন্ধনের আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে তৎপরতা শুরু হবে।