২ জামায়াত কর্মী ছনখোলায় কেন গেলেন, উত্তর খুঁজছে পুলিশ


২ জামায়াত কর্মী ছনখোলায় কেন গেলেন, উত্তর খুঁজছে পুলিশ
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাবল মার্ডার ঘিরে সৃষ্ট রহস্যের ধূম্রজাল কাটেনি দুদিনেও। নিহত নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে নিজেদের কর্মী দাবি করা জামায়াতে ইসলামী একে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। নিহতদের পরিবারও বলছে একই কথা। রহস্যের ডালপালা ছড়িয়েছে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া রিভলবার ঘিরেও। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতের এই দুই কর্মী কেন ছনখোলা গিয়েছিলেন, সেটিসহ আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ।সোমবার রাত ১০টার দিকে সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা ১ নম্বর ওয়ার্ডে চূড়ামণি গ্রামে মাইকে ‘ডাকাত পড়েছে’ ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে। নেজাম উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার মাহমুদুল হকের ছেলে এবং ছালেক একই ইউনিয়নের গুরগুরি এলাকার আবদুর রহমানের ছেলে। স্থানীয়দের বয়ানে, ডাকাত পড়েছে শুনে লোকজন নেজাম ও ছালেককে ঘিরে ধরলে তাদের সহযোগীরা গুলি চালায়। এতে আহত হয় পাঁচজন। তারা হলেন ছনখোলা এলাকার বাসিন্দা ওবায়দুল হক (২২), নাসির উদ্দিন (৩৮), আব্বাস উদ্দিন (৩৮), মো. মামুনুর রশিদ (৪৫) ও ইকবাল। তাদের নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।কী বলছেন স্থানীয়রা: এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার রাত সাড়ে ৯টার পর চার থেকে পাঁচটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নেজাম, ছালেকসহ ১০ থেকে ১২ জন সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকার একটি দোকানের সামনে নামেন। তখন স্থানীয় মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত আসছে, ডাকাত আসছে’ ঘোষণা দেওয়া হয় একাধিকবার। একপর্যায়ে এলাকাবাসী সংঘবদ্ধ হয়ে নেজাম ও তার সহযোগীদের ঘিরে ফেলে। এ সময় নেজামের সহযোগীরা জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। অন্তত শতাধিক রাউন্ড গুলি ছোড়েন তারা। একপর্যায়ে নেজামের সহযোগী জামশেদসহ অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও নেজাম ও সালেককে লোকজন লাঠিসোটা ও দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।নেজামের বিরুদ্ধে আছে লুটপাটের অভিযোগ: এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬ সালে অক্টোবরে এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২৫ মামলার আসামি তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আবুল বশর ওরফে বদাইয়া (৪০) নিহত হন। এলাকায় তিনি জামায়াতের ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে হত্যার পেছনে আওয়ামী লীগ নেতা ও এওচিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছিলেন বশরের সহযোগীরা।জানা যায়, সেই আবুল বশরের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন নেজাম উদ্দিন। বশর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর নেজাম সৌদি আরব চলে যান। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর নেজাম এলাকায় ফেরেন। এরপর থেকে তিনি ও তার সহযোগীরা এওচিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের ঘরবাড়ি-খামারসহ বিভিন্ন স্থাপনায় কয়েক দফায় লুটপাট চালান। এ নিয়ে সম্প্রতি নজরুল ইসলাম মানিকের স্ত্রী রুনা আকতার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বরাবর অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, নেজাম এবং তার সহযোগী ইকবাল ও ফারুকের নেতৃত্বে জামায়াত ক্যাডার হিসেবে পরিচিত অন্তত ৫০ জন সন্ত্রাসী গত বছরের ডিসেম্বরের শুরু থেকে টানা ১৫ দিন ধরে নজরুল ইসলাম মানিকের খামার থেকে ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক ভর্তি করে মাছ তুলে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাক নিয়ে এসে মানিকের মালিকানাধীন কেবিএম ব্রিকফিল্ড থেকেও ২ কোটি টাকার ইট নিয়ে যায়।ফ্যাসিস্টদের চক্রান্তে হত্যাকাণ্ড, বলছে জামায়াত: ঘটনার পর উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা কামাল উদ্দিন ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ তারেক হোছাইন এবং এওচিয়া ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আবু বক্কর ও সেক্রেটারি ফারুক হোসাইন গণমাধ্যমে বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, ওই দুই জামায়াতকর্মীকে পরিকল্পিতভাবে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।বিবৃতিতে তারা অভিযোগ করেন, ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের পর নেজাম এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করলেও এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সন্ত্রাসী নজরুল ইসলাম মানিক চেয়ারম্যানের বাহিনী এখনো রয়ে গেছে। তার ভাই হারুন ও মমতাজ এখনো নানা অপকর্মে জড়িত।বিবৃতিতে বলা হয়, পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী দুঃশাসনে নির্যাতিত ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে বিচারের কথা বলে ডেকে নেওয়া হয়। মাইকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ডাকাত আখ্যা দিয়ে গণপিটুনির নামে চেয়ারম্যান মানিকের নির্দেশে তার ভাইদের পরিকল্পনায় কুপিয়ে দুজনকে জঘন্যতম কায়দায় হত্যা করা হয়, যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত না করে আসল হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন জামায়াত নেতারা।জামায়াতে ইসলামীর সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের সেক্রেটারি জায়েদ হোছেন বলেন, নিহত ব্যক্তিরা জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একটি সালিশ বৈঠকের কথা বলে তাদের এওচিয়া এলাকায় ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুজনের মাথায় পর্যায়ক্রমে আঘাত করা হয়। ফ্যাসিস্টদের চক্রান্তে জেনেশুনে এ হত্যাকাণ্ড ঘটনানো হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কাউকে সেখানে যেতে দেয়নি। গাছ কেটে সড়কে ফেলে রাখা হয়েছিল।উদ্ধার হওয়া অস্ত্র থানা থেকে লুট করা, অনুমান পুলিশের: চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সনতু সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে যে অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি থানা থেকে লুট করা অস্ত্র বলে আমরা প্রাথমিকভাবে অনুমান করছি। সেটি খতিয়ে দেখার জন্য আমরা পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠিয়েছি। কোন ইউনিটের অস্ত্র তখন তা জানা যাবে।’এদিকে রাজনৈতিক বিরোধে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি না—জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বিষয়টি তদন্তনাধীন উল্লেখ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হয়নি মামলা: নেজাম ও ছালেকের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের আগে দায়ের হওয়া একাধিক মামলা আছে বলে জানিয়েছেন সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে কিছু মামলা বিচারাধীন, আর কিছু মামলা তদন্তাধীন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেননি। তারা এত রাতে কেন ওই গ্রামে গেলেন, গ্রামবাসীর মধ্যে ডাকাত আতঙ্ক কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল—এগুলো আমরা তদন্ত করে দেখছি।’দুই জামায়াতকর্মী খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে কি না—জানতে চাইলে সাতকানিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সুদীপ্ত রেজা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তারা ওই এলাকায় এত রাতে কেন গিয়েছিল সেটা নিয়ে দুরকমের তথ্য পেয়েছি আমরা। আশা করি তদন্তে সত্যটা বের হয়ে আসবে।’