
পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম ড্রোন যুদ্ধ হলো দক্ষিণ এশিয়ায়।ভারত গত বৃহস্পতিবার অভিযোগ করে, পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ড ও ভারত শাসিত কাশ্মীরের তিনটি সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে ইসলামাবাদ দ্রুতই সে অভিযোগ অস্বীকার করে।অন্যদিকে, পাকিস্তান দাবি করে, তারা ২৫টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। যদিও দিল্লি এখনো প্রকাশ্যে এ নিয়ে কিছু বলেনি।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কয়েক দশকের পুরনো দ্বন্দ্বে ‘টিট-ফর-ট্যাট’ হামলার এই নীতি একটা ‘বিপজ্জনক’ এবং নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কারণ উভয় পক্ষই অস্থিতিশীল সীমান্তে কেবল গোবারুদ নয়, ড্রোনের মতো মানবহীন অস্ত্রও ব্যবহার করেছে।ওয়াশিংটন ও অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তিগুলো যখন উভয়পক্ষকে ‘সংযম প্রদর্শনের’ আহ্বান জানাচ্ছে, তখন ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান কিন্তু তাদের মধ্যে উত্তেজনার বৃদ্ধি একটা রিমোট (দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত), ‘নীরব’ ও ‘অস্বীকারযোগ্য’ সংঘাতের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।‘ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজ’-এর অধ্যাপক জাহারা মাতিসেক বিবিসিকে বলেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ড্রোন সংঘর্ষ একটা নতুন যুগে প্রবেশ করছে, যেখানে অদৃশ্য চোখ এবং আনম্যানড প্রিসিসন (মানবহীন পদ্ধতির নিখুঁত পরিমাপ) উত্তেজনা বা সংযম নির্ধারণ করতে পারে’।‘সুতরাং, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আকাশে, ড্রোন যুদ্ধে পারদর্শী পক্ষরা কেবল যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করবে না, তাকে আকারও দেবে’।পাকিস্তান প্রথম অভিযোগ তুলে বলেছে, বুধবার সকাল থেকে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় বিমান হামলা ও সীমান্তে গোলাগুলিতে ৩৬ জন নিহত ও ৫৭ জন আহত হয়েছেন।অন্যদিকে, ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের তরফে গোলাবর্ষণে অন্তত ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে।ভারত জোর দিয়ে বলেছে, পেহেলগাম হামলার জবাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা (৭ মে) চালানো হয়েছে। তবে ইসলামাবাদ ২২ এপ্রিলের পেহেলগাম হামলার পেছনে তাদের কোনো ধরনের ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছে।পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বৃহস্পতিবার ঘোষণা দেয় যে, তারা করাচি, লাহোর এবং রাওয়ালপিন্ডিসহ বিভিন্ন শহরে ২৫টা ভারতীয় ড্রোনকে ভূপাতিত করেছে। দাবি অনুযায়ী, ভূপাতিত করা ওই ড্রোনগুলো ইসরাইলের তৈরি হারোপ ড্রোন এবং প্রযুক্তিগত ও অস্ত্রভিত্তিক পাল্টা ব্যবস্থা ব্যবহার করে সেগুলো প্রতিহত করা হয়েছে।পরে ভারত দাবি করেছে, তারা পাকিস্তানের কয়েকটা বিমান প্রতিরক্ষা রাডার এবং সিস্টেম নিষ্ক্রিয় করেছে, যার মধ্যে একটা লাহোরে অবস্থিত। ইসলামাবাদ অবশ্য এ দাবিকে খারিজ করে দিয়েছে।‘লেজার-গাইডেড’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা, ড্রোন ও ‘আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকলস’ (ইউএভি) আধুনিক যুদ্ধে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এগুলো সামরিক অভিযানের নির্ভুল হওয়া এবং নিখুঁত দক্ষতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। এটা বিমান হামলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্থানাঙ্কগুলো রিলে করতে পারে বা যদি ডিজাইন করা হয় তাহলে সরাসরি ‘লেজার-ডেজিগনেশনের’ মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করতে এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ায় সাহায্য করতে পারে।ড্রোন মূলত ‘শত্রুর’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দমন করতে বা ‘ফাঁদ’ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শত্রু রাডার নির্গমনকে ‘ট্রিগার’ করার জন্য ‘প্রতিযোগিতামূলক’ আকাশসীমায় উড়ে যেতে পারে, যা পরে ‘লয়টারিং ড্রোন’ বা ‘অ্যান্টি-রেডিয়েশন’ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা নিশানা করা যেতে পারে।অধ্যাপক জাহারা মাতিসেক বলেছেন, ‘ইউক্রেন ও রাশিয়া দু’দেশই তাদের যুদ্ধে এভাবেই কাজ করে। এই দ্বৈত ভূমিকা অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তু করা এবং ট্রিগার করার বিষয়টা ড্রোনকে মনুষ্যবাহী বিমান ব্যবহারের ঝুঁকি ছাড়াই শত্রু আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে হ্রাস করার শক্তি বাড়িয়ে তোলে’।বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ড্রোনের বহর মূলত ‘আইএআই সার্চার’ এবং ‘হেরনের’ মতো ইসরাইলের তৈরি ইউএভি ও ‘হার্পি’ এবং ‘হারোপ লোটারিং মিউনিশনের’ মতো করে নির্মিত, যে ড্রোনগুলো ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই দ্বিগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন, স্বায়ত্তশাসিত পুনরুদ্ধার করতে এবং নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘হারোপ’ (লয়টারিং মিউনিশন বা ভ্রাম্যমাণ যুদ্ধাস্ত্র) উচ্চমূল্যের, নির্ভুল-লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করার মাধ্যমে আধুনিক সংঘাতের ক্ষেত্রে লয়টারিং মিউনিশনের মতো যুদ্ধাস্ত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘হেরন’ শান্তিকালীন পর্যবেক্ষণ এবং যুদ্ধ অভিযান দুই ক্ষেত্রে ‘আকাশের উচ্চতায় চোখ রাখতে’ ভারতকে সাহায্য করেছে।‘আইএআই সার্চার’ ‘এমকে-২’ ফ্রন্টলাইন অভিযানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যার সহনশীলতা ১৮ ঘণ্টার এবং এটা ৩০০ কিলোমিটার পরিসীমা এবং ৭০০০ মিটারের ‘সার্ভিস সিলিং’ সরবরাহ করে।অনেকে বিশ্বাস করেন যে, ভারতের যুদ্ধ ড্রোনের সংখ্যা ‘পরিমিত’। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩১টা ‘এমকিউ-৯বি প্রিডেটর ড্রোন’ কেনার জন্য ৪০০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে ভারত। এই পদক্ষেপ ভারতের ‘আঘাত হানার’ ক্ষমতাকে অনেকটাই বাড়িয়েছে। এই ড্রোন ৪০ ঘণ্টা ধরে উড়তে পারে এবং ৪০,০০০ ফুট উচ্চতায় যেতে পারে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ড্রোনের বহরের কৌশলও বিকশিত হয়েছে। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ‘অভিভূত’ ও ‘পরিপূর্ণ’ করার জন্য বিপুল সংখ্যক ছোট ‘ইউএভি’ মোতায়েন করেছে ভারত। যাতে ভারতের উচ্চমূল্যের সিস্টেমগুলো নির্দিষ্ট আকাশপথে প্রবেশ করতে পারে।এদিকে পাকিস্তানের ড্রোন বহরও ‘বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়’ বলে উল্লেখ করেছেন লাহোর-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এজাজ হায়দার। তিনি বিবিসিকে বলেন, এতে দেশীয় সিস্টেম রয়েছে আবার আমদানি করা সিস্টেমও আছে।তিনি বলেন, পাকিস্তানের ঝুলিতে ‘এক হাজারেরও বেশি ড্রোন’ রয়েছে। যার মধ্যে চীন, তুরস্ক- এমনকি দেশীয় নির্মাতাদের মডেলও রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে চীনা ‘সিএইচ-৪’, তুরস্কের ‘বায়রাক্তার আকিনজি’ এবং পাকিস্তানের ‘বুরাক’ ও ‘শাহপার’ ড্রোন। উপরোন্তু পাকিস্তান তার আক্রমণের সক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে এবং যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করেছে।এজাজ হায়দার জানিয়েছেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনী (পিএএফ) প্রায় এক দশক ধরে সক্রিয়ভাবে তাদের অভিযানে আনম্যান্ড সিস্টেমকে (মনুষ্যবিহীন সিস্টেমকে) অন্তর্ভুক্ত করছে।তিনি আরও বলেন, মূল ফোকাস হলো ‘লয়াল উইংম্যান ড্রোনের’ বিকাশ। এটা মনুষ্যবাহী বিমানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য ডিজাইন করা ইউএভি।অন্যদিকে অধ্যাপক মাতিসেক মনে করেন, ‘হারোপ এবং হেরন ড্রোন সরবরাহকারী ইসরাইলের প্রযুক্তিগত সহায়তা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে তুরস্ক ও চীনা প্ল্যাটফর্মের ওপর পাকিস্তানের নির্ভরতা, চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতাকেই তুলে ধরে’।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক ড্রোন বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে যে ধরনের ড্রোন-কেন্দ্রিক যুদ্ধ নজরে এসেছে, তার সঙ্গে এর স্পষ্টতই পার্থক্য রয়েছে। সেখানে ড্রোন সামরিক অভিযানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন উভয় পক্ষকেই নজরদারি, লক্ষ্যবস্তু এবং সরাসরি আক্রমণের জন্য হাজার হাজার ইউএভি মোতায়েন করতে দেখা গেছে।ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মনোজ যোশী বলেছেন, ‘যুদ্ধবিমান বা ভারি ক্ষেপণাস্ত্রের পরিবর্তে ড্রোন মোতায়েন করা নিম্ন স্তরের সামরিক বিকল্পের প্রতিনিধিত্ব করে। ড্রোন মনুষ্যবাহী বিমানের চেয়ে কম সশস্ত্র। তাই এক অর্থে, এটা এক ধরনের সংযত পদক্ষেপ। তবে এটা যদি নিছক বিস্তৃত বিমান অভিযানের পূর্বপ্রস্তুতি হয়, তাহলে কিন্তু হিসেব-নিকেশ পুরোপুরি পাল্টে যাবে’।অন্যদিকে ইজাজ হায়দারের মতে, জম্মুতে ড্রোন তৎপরতা ‘তাৎক্ষণিক উসকানির একটা কৌশলগত প্রতিক্রিয়া বলে মনে হচ্ছে। (পাকিস্তানের দিক থেকে) এটা পূর্ণ মাত্রার প্রতিশোধ নয়’।তিনি বলেন, ‘ভারতের বিরুদ্ধে (পাকিস্তানের তরফ থেকে) সত্যিকারের প্রতিশোধমূলক হামলা হলে, তা হবে বিস্ময়কর। সম্ভবত তা আরও বিস্তৃত হবে, একাধিক প্ল্যাটফর্ম- যেমন মনুষ্যবাহী ও মানবহীন দুই ধরনের প্ল্যাটফর্মই জড়িত থাকবে এবং তা বিস্তৃত পরিসরকে লক্ষ্য করে চালানো হবে। এ ধরনের অপারেশনের লক্ষ্য হবে একটা সিদ্ধান্তমূলক প্রভাব বিস্তার করা, যা বর্তমান টিট-ফর-ট্যাট এক্সচেঞ্জের বাইরে গিয়ে একটা উল্লেখযোগ্য উত্তেজনা বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করবে’।বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেন-রাশিয়ার ক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার মৌলিকভাবে নতুন রূপ দিলেও ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ক্ষেত্রে ড্রোনের ভূমিকা আরও সীমিত এবং প্রতীকী রয়ে গেছে। দুই দেশই একে অপরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে তাদের মনুষ্যবাহী বিমান বাহিনীও ব্যবহার করেছে।মনোজ জোশী বলেছেন, ‘আমরা যে ড্রোন যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছি, তা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে; এটা একটা বৃহত্তর সংঘাতের সূচনাও হতে পারে’।‘এটা হয় উত্তেজনা প্রশমন অথবা উত্তেজনা বৃদ্ধির সংকেত দিতে পারে। আবার উভয় সম্ভাবনাই রয়েছে। আমরা একটা প্রতিবিম্ব বিন্দুতে আছি; এখান থেকে আমরা কোন দিকে যাব, তা অনিশ্চিত’।স্পষ্টতই ভারত তার ‘প্রিশিসন-স্ট্রাইক’ (লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করতে পরিমিত ও নিখুঁতভাবে ব্যবহার) করতে ড্রোনকে ব্যবহার করেছে। মনুষ্যবাহী বিমানের সাহায্যে সীমান্ত অতিক্রম না করেই ‘স্ট্যান্ড অফ টার্গেট’কে নিশ্চিত করছে। তবে এই বিবর্তন সমালোচনামূলক প্রশ্নও উত্থাপন করে।অধ্যাপক মাতিসেক বলেন, ‘ড্রোন রাজনৈতিক ও অপারেশনাল অ্যাকশনের সীমাকে কমিয়ে দেয়। নজরদারি ও আঘাত হানার বিকল্প সরবরাহ করে এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি হ্রাস করার চেষ্টা করে’।‘কিন্তু তারা উত্তেজনা বৃদ্ধির নতুন গতিশীলতাও তৈরি করে যেখানে প্রতিটা ড্রোন ভূপাতিত করা হয়, প্রতিটা রাডার বন্ধ করা হয় এবং দু’টো পারমাণবিক শক্তির মধ্যে এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে এটা একটা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে’। সূত্র: বিবিসি
