যে কারণে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ভারত-পাকিস্তান


যে কারণে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ভারত-পাকিস্তান
যুদ্ধের খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে শত্রুপ্রতিম দুই প্রতিবেশী ভারত এবং পাকিস্তান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম জানিয়েছিলেন যে পুরোদমে যুদ্ধে জড়াচ্ছে না দুই দেশ। কারণ দুই পরমাণু শক্তিধর সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে গেছে। অথচ এর আগে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স দুই দেশের সংঘাতে হস্তক্ষেপ করবেন না বলে জানিয়েছিলেন। এরপর কী এমন ঘটল যে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা করল? এ নিয়েই চলছে আলোচনা। এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাশ্মীর নিয়ে স্থায়ী সমস্যার সমাধানে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যে কারণে দ্রুত কাজ করে যুক্তরাষ্ট্র গত শনিবার বিকালে এক্স হ্যান্ডেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ‘ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘রাতভর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনার পরে আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে ভারত এবং পাকিস্তান সম্পূর্ণ এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। বাস্তবজ্ঞান এবং বুদ্ধি প্রয়োগ করার জন্য দুই দেশকেই ধন্যবাদ। এই ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেওয়ায় ধন্যবাদ।’ এরপরই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ভারত-পাকিস্তান দুই পক্ষই। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, যখন ঠিক একদিন আগেই আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের মধ্যে ঢুকবে না তারা। তারপর হঠাৎ কী এমন হলো যে খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করলেন। আর সেই সূত্রেই উঠে আসছে ভয়ংকর এক আশঙ্কার কথা।ভারত এবং পাকিস্তান যখন পূর্ণ যুদ্ধের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল, তখন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে এমনই দাবি করা হয়েছে। জানা গেছে, গত শুক্রবার সকালে আমেরিকা একটি ‘উদ্বেগজনক গোয়েন্দা তথ্য’ পেয়েছিল। তারা গোয়েন্দা তথ্যটি নির্দিষ্টভাবে কী, তা নিরাপত্তাজনিত কারণেই প্রকাশ করা হয়নি। তবে, এটা স্পষ্ট গুরুতর ছিল সেই গোয়েন্দা তথ্য। এরপরই শীর্ষ মার্কিন নেতৃত্ব জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। যার মধ্যে জেডি ভ্যান্স ও আমেরিকার অন্তর্বর্তী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং হোয়াইট হাউজের চিফ অফ স্টাফ সুজি ওয়াইলসও ছিলেন।সিএনএনের দাবি, ভ্যান্স মোদির সঙ্গে কথা বলার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পুরো বিষয়টি জানান। এরপরই ভ্যান্স প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ফোন করে ভয়াবহ গোয়েন্দা তথ্য সম্পর্কে অবহিত করেন। মোদির সঙ্গে কথা বলার সময়ই শনিবার ভ্যান্স প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং উত্তেজনা কমানোর বিকল্পগুলো বিবেচনা করতে আহ্বান জানান। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট, যিনি পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের সময় তার পরিবারের সঙ্গে ভারত সফরে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যা মার্কিন হস্তক্ষেপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফোনে এই কথোপকথনের পরপরই মার্কো রুবিও ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে রাতভর কথা বলেন। তাও তিনি করেন ফোনের মাধ্যমেই এবং এই যাত্রায় রুবিও ফোন করেন পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরকে। তবে মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতির চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করেনি, শুধু আলোচনা শুরু করিয়ে দেওয়াটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য।সিএনএন জানিয়েছে, মোদি-ভ্যান্স ফোনালাপই ছিল পরিস্থিতি বদলের প্রধান মুহূর্ত। কারণ সেই সময় পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি কোনো যোগাযোগ হচ্ছিল না এবং পরিস্থিতি দ্রুত হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এই ঘটনার পর শনিবার সন্ধ্যা ৫টা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। দুই দেশের সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা একে অপরের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন এবং সমস্ত সামরিক হামলা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে পৌঁছান।কাশ্মীর নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রশংসা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে এক পোস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেরই শক্তিশালী এবং অটল নেতৃত্বের জন্য আমি অত্যন্ত গর্বিত।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লিখেছেন, সঠিক সময়ে তিনি প্রজ্ঞা এবং সাহস দেখিয়েছিলেন এবং এই সংঘাত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ এই সংঘাতের ফলে লাখ লাখ নিরীহ মানুষের মৃত্যু এবং বিশাল ক্ষতি হতে পারতো। তিনি আরও বলেন, ‘আমেরিকা আপনাকে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পেরেছে বলে আমি গর্বিত।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির কথাও বলেছেন তার পোস্টে। এর পাশাপাশি, ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একসঙ্গে কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার কথাও বলেছেন ট্রাম্প।যুদ্ধে উভয় দেশের ক্ষতি গত ৭ মে ভারত পাকিস্তানে হামলার ক্ষেত্রে রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান রেকর্ড গড়ে। তারা তিনটি রাফাল বিমান ভূপাতিত করার কথা জানায়। পাকিস্তান আরও দাবি করে, তারা ভারতের ৭৭টি ড্রোন (ইসরাইলের তৈরি) ভূপাতিত করেছে। যুদ্ধের অর্থনৈতিক ধাক্কাও বড় ছিল। দুই দেশের মোট ক্ষতি হয় ৮৭ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার বেশি)। ভারতের স্টক মার্কেট, আকাশপথ ও বিনিয়োগে বড় ধরনের পতন হয়। ৮৭ ঘণ্টা ২৫ মিনিট ধরে চলা সংঘাতের মধ্যে ভারতের নিফটি ৫০ ও বিএসই সেনসেক্স সূচকসমূহ মিলিয়ে ৮২ বিলিয়ন ডলার মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন হারায়। উত্তর ভারতের আকাশপথ বন্ধ থাকায় প্রতিদিন ৮ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বিমান ক্ষতি হয়।ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) স্থগিত হওয়ায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় টিভি স্বত্ব, টিকিট বিক্রি ও বিজ্ঞাপন থেকে। সামরিক অভিযানে খরচ পড়ে ১০০ মিলিয়ন ডলার, রাফাল যুদ্ধবিমানের ক্ষতির মূল্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার। পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় ক্ষতি দাঁড়ায় ২ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারানো ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমার ফলে প্রভাব পড়ে অতিরিক্তভাবে। মোট ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার (১০ লাখ কোটি টাকার বেশি)।অন্যদিকে, একই সময়ে পাকিস্তানের কেএসই-১০০ সূচক ৪ দশমিক ১ শতাংশ কমে যাওয়ায় প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার হারায়। পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) স্থগিত হওয়ায় ১০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় সম্প্রচার ও সম্পর্কিত খাত থেকে। আকাশপথ বন্ধ থাকায় বিমান খাতে ২০ মিলিয়ন ডলার লোকসান হয়। সামরিক অভিযানে দৈনিক ২৫ মিলিয়ন ডলার, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে (বেরাখটার এবং রাদ এএলসিএম) খরচ হয় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগ আস্থা কমে গেলেও তা পরিমাপ করা যায়নি। পাকিস্তানের মোট ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার (৪৮ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বেশি)। সেই হিসাবে এই সংঘাতে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২২ গুণ বেশি।স্বাভাবিক অবস্থা ফিরছেপাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন জানিয়েছে, দুই দেশেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। বিবিসিও জানিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীর এবং আজাদ কাশ্মীরেও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। অমৃতসরে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে এসেছে, তবে রেড অ্যালার্ট এখনো জারি রয়েছে। যদিও এরই মধ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনী জানিয়েছে, অভিযান এখনো চলছে। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম এক্স (সাবেক টুইটার) এ একটি পোস্টে বলেছেন, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করলে কমান্ডারদের পালটা জবাব দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছেন ভারতের সেনাপ্রধান।ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং শিগগিরই আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে বলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে। শনিবার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের পরিচালক ওয়াং ই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দুজনের কথোপকথনের ভিত্তিতে এ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। ঐ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘দোভাল বলেন, ভারতের পহেলগামে হামলায় ভারতীয়দের মধ্যে গুরুতর হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে ভারত কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধ ভারতের পছন্দ না এবং এটি কোনো পক্ষের স্বার্থেও নয়। ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং শীঘ্রই আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।’ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পহেলগাম হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, চীন সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে। এদিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানিয়েছেন, ভারতের স্থগিত করা সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি, বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে। তবে কবে কখন আলোচনা শুরু হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।