হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক গল্পের নাটক
অনলাইন নিউজ ডেক্স

বিটিভির যুগে টিভি নাটকে গুরুত্ব পেতো পারিবারিক গল্প। নাটকগুলোতে পরিবার তথা সমাজ ও জীবনের গল্পই দেখা যেতো। যেখানে পারিবারিক বন্ধনের কথা জোর দিয়ে বলা হতো। শুধু নায়ক-নায়িকাই সেসব নাটকের প্রধান বিবেচ্য ছিল না। পারিবারিক গল্পের নাটক হওয়াতে সেগুলোতে মা-বাবা’সহ অনেক চরিত্রের দেখা মিলতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে নাটকগুলো নায়ক-নায়িকা নির্ভর। পারিবারিক গল্পের নাটকের যেন আকাল পরেছে। বিলীন হতে চলেছে পারিবারিক গল্পের নাটক। নায়ক-নায়িকার বাইরে দুই একটি পার্শ্ব চরিত্র রাখা হলেও, সেগুলোর উপস্থিতি ও গুরুত্ব তেমন থাকে না। আর তাতে করে যেমন কমছে সিনিয়র শিল্পীদের কাজের পরিমান, তেমনি নাটকে থাকছে না প্রাণ। লিখেছেন রিয়েল তন্ময়গত ঈদ-উল-ফিতরে মুক্তি পেয়েছিল অনেকগুলো নাটক। তার মধ্যে ছিল কয়েকটি পারিবারিক গল্পের নাটক। ‘তোমাদের গল্প’ ও ‘একান্নবর্তী নামের নাটক দুটি বেশ দর্শক সমাদৃত হয়েছে। মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ পরিচালিত ‘তোমাদের গল্প’ নাটকের গল্পে যৌথ পরিবারের মাঝে বন্ধন অটুট থাকার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ‘একান্নবর্তী’ নাটকটি পরিচালনা করেছেন মহিন খান। এতেও উঠে এসেছে একান্নবর্তী পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গল্প। আলোচনার পাশাপাশি নাটকগুলো ছিল ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে। অর্থাৎ, পারিবারিক গল্পের নাটকের প্রতি এখনও দর্শকদের আগ্রহ রয়েছে এটা বলতেই হয়। তবুও কেন নির্মিত হচ্ছে না এসব নাটক। এখন নায়ক-নায়িকার পাশাপাশি কয়েকটি পার্শ্বচরিত্র দিয়েই নির্মিত হচ্ছে নাটক। এদিকে ইউইউবে হাসির নাটকের ভিউ বেশি হয় বলে দাবি করছেন নির্মাতারা। সেজন্য রাখা হয় কৌতুক অভিনেতা। যাদের প্রধান কাজ হল বিকৃত শারিরীক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যে কোনো মূল্যে দর্শককে হাসানো। আর এগুলোকে হাসির নাটক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, এগুলো দর্শক বেশি পছন্দ করেন। এক সময় নাটক দেখার বিষয় থাকলেও, বর্তমানে সেটি ‘খাওয়ার’ পর্যায়ে চলে গেছে। ব্যাপারটি সতিই নাটকের ভবিষ্যৎকে ভয়ংকর বিপদ সংকেতের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেও মনে করছেন নাট্যবোদ্ধারা।নাটকের স্বর্ণযুগের উদাহরন দিয়ে বলতে গেলে ‘সংশপ্তক’, ‘মাটির কোলে’, ‘জোনাকী জ্বলে’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘সকাল সন্ধ্যা, ‘সময় অসময়’, ‘স্বপ্নের শহর’, ‘কোন কাননের ফুল’ ‘দিনরাত্রির খেলা’, ‘বেলা অবেলা’ ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘ঢাকায় থাকি’সহ আরও অনেক নাটক রয়েছে যা এখনোও দর্শকের মনে দাগ কেটে যায়। একটু অতীতে গেলে দেখতে পাব, বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপক আলোচিত ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’র শেষ পর্বে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে দর্শকদের মধ্যে ব্রাপক শোরগোল হয়েছিল। ওই নাটকে ‘কুত্তাওয়ালী’ নামে একটি চরিত্রে যিনি অভিনয় করতেন তার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কুত্তাওয়ালীর ষড়যন্ত্রের কারণে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় হয়েছে। সেজন্য কুত্তাওয়ালীর প্রতি দর্শক ক্ষুব্দ হয়ে উঠেছিল।অন্যদিকে ‘ঢাকায় থাকি’ নামে বিটিভির আরও একটি জনপ্রিয় ধারবাাহিকে ‘টুনী’ নামে একজন শিশু চরিত্রের শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। নাটকের কাহিনীতে দেখা যায় টুনীর আর বাঁচার সম্ভাবনা নাই। সারাদেশে তার রোগ মুক্তির জন্য দর্শকের প্রার্থনা শুরু হয়েছিল। এসব নাটক কিন্তু সমাজের নানাচিত্র দেখানোর পাশাপাশি পারিবারিক কাহিনী বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। এখনোও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজর দিলে দেখা যাবে, এসব নাটকের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ভেসে বেড়াচ্ছে। দর্শকের প্রচুর আগ্রহ এইসব ভিডিও ক্লিপের প্রতি। অর্থাৎ, দর্শক পারিবারিক কাহিনী সমৃদ্ধ নাটক দেখার ব্যাপারে এখনও বেশ আগ্রহী।খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০১৭ সালে প্রকাশ হওয়া ‘বড় ছেলে’ নামে একটি নাটক বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জনপ্রিয় অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব ও মেহজাবীন চৌধুরী অভিনীত পারিবারিক নাটকের ধারায় নির্মিত এ নাটকটি কাঁদায়নি এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচালিত এ নাটকটি এখনও দর্শকের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। এরপর আর কোনো পারিবারিক গল্পের নাটক দেখা যায়নি। যদি কয়েকটি হয়েও থাকে, সেগুলো সেভাবে আলোচনায় আসতে পারেনি।কেন পারিবারিক গল্পের নাটক নির্মাণে অনাগ্রহ পরিচালকদের? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে বেশ কয়েকজন নাট্যকার ও নির্মাতাদের সঙ্গে কথা হয়। সবাই বাজেটের বিষয়টিকেই বাধা হিসাবে উপস্থাপন করছেন। দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু আসলেই কী দায় এড়ানো যায়? এমন প্রশ্নে কেউই কোনো সদুত্তর দিতে পারছেন না। বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্তমান সময়ের ব্যস্ত এক নাট্যকার বলেন, ‘এখন নির্মাতারা নাটকে অধিক চরিত্র পছন্দ করেন না। বেশি চরিত্রের নাটককে তারা ঝামেলা মনে করেন। এছাড়াও বাজেট কম বলেও আমাদের হাত বেধে দেন। তাই বাধ্য হয়েই আমাদেরও তাদের চাহিদামতো নাটক লিখতে হয়। আমি, তুমি, সেÑএ তিন চরিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। বলা যায়, আমরা এখন ফরমায়েশি লেখক হয়ে গেছি।’নির্মাতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, এখন সব জিনিষের দাম বাড়লেও, কেবল বাড়ছে না নাটকের দাম। ২০ বছর আগেও যে খরচ দেয়া হত, এখনও সেই হিসাবে খরচ দেয়া হয়। শুটিং বাড়ির ভাড়া বাড়ার পাশাপাশি শিল্পীর সম্মানি বৃদ্ধি হলেও তারা সেভাবে বাজেট পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।অন্যদিকে এখন টিভির চেয়ে অনলাইনের জন্যই বেশি নাটক নির্মিত হয়। আর এদিকেই প্রযোজকদের নজর বেশি। একাধিক প্রযোজকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সাধ থাকলেও সাধ্যের মধ্যে না হওয়াতে তারাও খুব বেশি অর্থ লগ্নি করতে চাচ্ছেন না। ইউটিউবে সেভাবে অর্থ উঠে আসছে না। বেশি বাজেটের নাটক নির্মাণ করলে, ভিউ দিয়েই শুধু ইউটিউব থেকে সে টাকা তুলে আনাও সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তাদেরও স্পন্সরের আশার তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য ঘুরতে হয়। এটিও সময় মতো না পাওয়ায় নাটক প্রচারেও বিলম্ব হয়। সেদিক বিবেচনায় কম বাজেটের মধ্যে নাটক নির্মাণ করছেন। তাতে করে নাটককে দুই বা তিন চরিত্রের গন্ডিতে আটকে দেয়া হচ্ছে।
