প্রতারক রনি এখনো দাপটে
ভুপাল চন্দ্র রায়, জেলা সংবাদদাতা, নওগাঁ, রাজশাহী

নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার পাটিচড়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের ছাবেদুল ইসলাম। তার ডাক নাম রনি। তিনি ওই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। পাশাপাশি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। এক সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটে করেছেন নানা অপকর্ম, কো-অপারেটিভ কোম্পানির নামে প্রতারণা করে স্থানীয়দের কাছ থেকে হাতিয়েছেন শতকোটি টাকা। সরকার পরিবর্তন হলেও বদলায়নি তার প্রতারণা। ফের ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে ফাঁদ পেতেছেন নানা প্রতারণা আর দখলের।এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি শহরের স্টেডিয়ামপাড়া এলাকায় এক নারীর ফ্ল্যাট দখলে নিয়েছেন। এর আগে পুরো পরিবারটির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করে তাদের হয়রানি শুরু করেন। তার অপকর্ম সম্পর্কে সবাই অবগত থাকলেও আতঙ্কে কেউ মুখ খোলেন না।স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, রনিকে সবাই চেনে নওগাঁ-২ (পত্নীতলা-ধামুইরহাট) আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে। এক সময়ে সাবেক ওই প্রতিমন্ত্রীর দাপটে তিনি পত্নীতলা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। সরকার পতনের পর ভোল পাল্টে ফের ক্ষমতার বলয়ে চলে আসেন।পত্নীতলার লোকজন বলছেন, এই রনির মাধ্যমে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তার গড়ে তোলা ‘সুরমা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি এনজিওতে আমানত রেখে দেড় হাজারের বেশি গ্রাহক হারিয়েছেন অন্তত তিনশ কোটি টাকা। সাধারণ মানুষের টাকা ফেরত না দিয়ে সেই টাকায় করেছেন ‘সুরমা ব্রিকস-১’ ও ‘সুরমা ব্রিকস-২’ নামে দুটি ইটভাটা। সেই ইটভাটা নিয়েও করেছেন প্রতারণা। শুধু তাই নয়, ববি রায় নামে এক গৃহবধূর কেনা একটি ফ্ল্যাটবাসা নিজের বলে দাবি করে তা দখলে রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে কথা বললেই নেমে আসে মিথ্যা মামলা।স্থানীয় সূত্র বলছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হন রনি। তখন জনতা তার অফিস ও গাড়ি ঘেরাও করলেও তিনি পালিয়ে যান। পরে তার অফিসে ভাঙচুর হয়। হাজার হাজার মানুষ জমা টাকার সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হন। তবে চাপে পড়েন তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা কর্মকর্তারা। এতে অন্তত দুই কর্মকর্তা আত্মহত্যা করেন। গত বছরের ২১ মার্চ নওগাঁ শহরের রজাকপুর এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে তার প্রতিষ্ঠানের সহকারী হিসাবরক্ষক সাবিনা ইয়াসমিনের ফাঁস লাগানো মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর আগে একইভাবে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বকুল কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির মান্দা পলাশবাড়ী শাখায় ব্যবস্থাপক পদে কর্মরত ছিলেন।ওই এলাকার ইট ব্যবসায়ীরা জানান, চেয়ারম্যান রনি ইট নিয়েও তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অগ্রিম প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। ওই ঘটনায় গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত ছাবেদুল ইসলাম রনির বিচারসহ পাওনা টাকা ফেরতের দাবিতে ইটভাটার সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। পরে তারা তৎকালীন জেলা প্রশাসক, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন।এদিকে, সম্প্রতি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে গৃহবধূ ববি রায়ের (২৯) নামে কেনা একটি ফ্ল্যাটবাসা নিজের দাবি করে দখলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের সুযোগে তিনি ওই ফ্ল্যাট বাসাটি নিজের দখলে রাখতে ববি রায়সহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সদর থানায় মামলা করেন। ভুক্তভোগী ববি রায় জানান, ২৫ লাখ টাকায় ফ্ল্যাটটি কিনে তার বাবা-মা তাকে উপহার দিয়েছিলেন। ফ্ল্যাটটি কেনার পর সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছিলেন। দলিল-খাজনা, খারিজ সবকিছু রয়েছে। তিনি বলেন, ফ্ল্যাটে অন্তত ৭ লাখ টাকার ফার্নিচার ছিল। যার সবই লুটপাট করেছে রনি ও তার লোকজন।ববি রায় বলেন, ‘আমাদের পরিবারের প্রায় ৪৯ লাখ টাকা সুরমা এনজিওতে আমানত হিসেবে জমা আছে। তাই এসব টাকা আত্মসাৎ করতে রনি উল্টো আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।ছাবেদুল ইসলাম রনি আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের অর্থের জোগানদাতা ছিলেন। এটা সবারই জানা। সেই রনিকে পুনর্বাসন করছেন পরাগ। যুবলীগ নেতার স্ত্রীর ফ্ল্যাট দখলে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা রনিকে সেখানে নিরাপদ আশ্রয় করে দিয়েছেন তিনি।পত্নীতলার একাধিক রাজনৈতিক নেতা বলেন, রনি আওয়ামী লীগের বড় অর্থদাতা বলে পরিচিত। কিন্তু সরকারের পটপরিবর্তনেও তার কিছু হয়নি। তিনি বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকে টাকা দিয়ে প্রকাশ্যে রয়েছেন। পাশাপাশি তাদের ব্যবহার করে নানা প্রতারণার ফাঁদ পেতেছেন। টাকার জোরেই তিনি অপরাধ করেও বারবার রেহাই পাচ্ছেন।অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ছাড়াও ছাবেদুল ইসলাম রনির অফিসে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইল নম্বরে দুই দিন চেষ্টা করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। সূত্র-কালবেলা
